হঠাৎ ছাড়ে কমল আয়

বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বড় ধরনের পাঁচটি শুল্ক-কর ছাড়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় কম হয়েছে। বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেনদরবার করে ব্যবসায়ীরা এসব সুবিধা আদায় করে নেন। পোশাকশিল্পের মালিকেরা রপ্তানির সময় উৎসে কর দুই দফা কমিয়েছেন। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইন্টারনেটে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। 

সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) রাজস্ব ক্ষতি নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে এই চিত্র উঠে এসেছে। বছরের শুরুর শুল্ক-কর ধরেই এনবিআরের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। বছরের মাঝখানে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়ায় এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতিকে আরও বড় করেছে। সংশোধিত লক্ষ্য থেকে এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মূল লক্ষ্য থেকে ঘাটতি ৭২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। 

এই বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বছরের শুরুতে কিংবা বছরের মাঝখানে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা শুল্ক-কর ছাড় দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এই কর ছাড় আদায় করেন। এটি অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। এনবিআরকে যে লক্ষ্য দেওয়া হয়, তা অর্জন না হওয়ার এটি একটি কারণ। তিনি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক চাপে না নেওয়ার পক্ষে মত দেন। 

কোথায় কত কমল

২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের এলএনজি আমদানির সুযোগ রয়েছে। অর্থবছর শুরু হওয়ার তিন মাস পর গত বছরের অক্টোবরে এলএনজি আমদানিতে ৯৩ দশমিক ২৪ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। এনবিআর বলছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের কারণে বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। 

বিদায়ী অর্থবছরের শুরুতেই তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর উৎসে কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ শতাংশ করা হয়। বাজেট ঘোষণার পর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর তৎকালীন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির করে উৎসে কর কমাবেন। তাঁর সেই ঘোষণা পরে সত্যি হয়েছে। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর এনবিআর পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। সেখানেই শেষ নয়, পোশাকশিল্পের মালিকেরা আরও কমানোর দাবি জানান। জাতীয় নির্বাচনের তিন দিন পর ৩ জানুয়ারি উৎসে কর আরও কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়। এনবিআর হিসাব করে দেখেছে, দুই দফা উৎসে কর কমানোর ফলে ২ হাজার কোটি টাকার কর কম আদায় হয়েছে। 

>এলএনজি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারে ১৪ হাজার কোটি টাকা
তৈরি পোশাকে উৎসে করে ২ হাজার কোটি টাকা
ইন্টারনেট ভ্যাট কমানোয় ৭২০ কোটি টাকা।


উৎসে করের পাশাপাশি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য আরও ছাড় দেওয়া হয় গত অর্থবছরে। তুলে নেওয়া হয় শ্রমিক কল্যাণ ও বিনোদনসংক্রান্ত খরচ, যানবাহন ভাড়া সেবা প্রদানকারী, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা, গবেষণাগারে পরীক্ষা মাশুলের ওপর আরোপিত সব ধরনের ভ্যাট। তাতে ২০০ কোটি টাকা কম ভ্যাট পেয়েছে এনবিআর। 

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ইন্টারনেট সেবার ওপর ভ্যাট আগের মতোই ১৫ শতাংশ রাখা হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে এনবিআর। ওই বছরের ২৮ জুন ইন্টারনেট সেবার ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ করা হয়। এনবিআরের হিসাবে, এতে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৭২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের উপকরণ সরবরাহে সব ধরনের শুল্ক-কর প্রত্যাহার করা হয়। এতে ১০০ কোটি টাকা শুল্ক-কর কম আদায় হয়েছে। 

গত অর্থবছরের বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু খাতে কর ছাড় দেওয়ার ফলে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের মডিউল ও প্যানেল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে কর ছাড়ে ৮৫ কোটি টাকা কম পাওয়া গেছে। এমএনপি সার্ভিসে সিম পরিবর্তনে ৫০ কোটি টাকার কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটন ট্রাভেল এজেন্টের সেবায় ভ্যাট প্রত্যাহার, শিশুদের লোশনে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার এবং কম্পিউটার যন্ত্রাংশ বিক্রি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির কারণে ১০ কোটি টাকা করে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। 

বছরের মধ্যে বিভিন্ন খাতে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়ার কারণে রাজস্ব লক্ষ্য আদায়ে ঘাটতি বেড়েছে বলে স্বীকার করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নির্বাচনের বছরের প্রথমার্ধে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু খাতে কর ছাড় দেওয়ার কারণে ঘাটতি বড় হয়েছে।