ছুরি-চাপাতি নিয়ে প্রস্তুত 'কাস্তে গ্রাম'

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়াইবাড়িয়ার এই কামারপল্লির মানুষ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়াইবাড়িয়ার এই কামারপল্লির মানুষ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার আড়াইবাড়িয়া গ্রামে ঢুকতে দূর থেকেই হাতুড়ি পেটানোর ধাতব শব্দ কানে ভেসে আসে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কেউ হাপর টানছেন, কেউ রেত দিয়ে তৈরি জিনিস ঘষামাজা করছেন, কেউ আবার চুলায় ছুরি, চাপাতি দিয়ে আগুনে গরম করছেন। কয়লার চুলোয় দগদগে আগুনে গরম লোহায় ছন্দময় পিটাপিটিতে মুখর হয়ে পুরো গ্রাম। আর কটা দিন পরই কোরবানির ঈদ। খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়াইবাড়িয়ার এই কামার পল্লির মানুষ। স্থানীয়ভাবে ‘কাস্তে গ্রাম’ নামে পরিচিত এটি।

আড়াইবাড়িয়ায় তিন শতাধিক পরিবার এ পেশায় নিয়োজিত। বাপ-দাদার আমল থেকেই তাঁরা এই কাজ করছেন। এখানকার তৈরি দা–বঁটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুখ্যাতি লাভ করেছে। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে আধুনিক জিনিসের মধ্যেও টিকে রয়েছে কামারপাড়ার তৈরি এসব জিনিস। দূরদূরান্ত থেকে পাইকারসহ খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতারা এসে এসব জিনিস কিনে নিয়ে যান। কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়াও পাশের নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলাতে এখানকার তৈরি জিনিস বিক্রি হয়।

গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল, কাঞ্চন নামের এক ব্যক্তি একটি শিশুকে নিয়ে ছুরি তৈরির কাজ করছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া তাঁর ভাইয়ের ছেলে রিফাত ইসলামকে নিয়ে কাজ করেন তিনি। রিফাত প্রতিদিন স্কুল শেষে এসে চাচার কাজে সহায়তা করে। শুধু রিফাত নয়, আড়াইবাড়িয়া গ্রামে অনেক শিশুই পড়ালেখার ফাঁকে বড়দের এসব কাজে সহায়তা করে থাকে।

আড়াইবাড়িয়া গ্রামের মো. সোহরাব উদ্দিন (৬০) জানান, তাঁর বাবা ইমাম উদ্দিনও এ পেশায় ছিলেন। বাবার কাছ থেকে তিনি শিখেছেন। এখন তাঁর ছেলে রাজন মিয়া (৩০) টিকিয়ে রেখেছেন বাপ-দাদার এ পেশা।

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়াইবাড়িয়ার এই কামারপল্লির মানুষ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়াইবাড়িয়ার এই কামারপল্লির মানুষ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

রাজনের মতো আসাদ মিয়া, জিল্লুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, সবুজ মিয়া, বোরহান উদ্দিন ও শরীফ মিয়া বলেন, লাভ হোক বা না হোক, বাপ-দাদার এ পেশা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

গ্রামের আরও কয়েকজন কামার জানালেন, লোহা-লাকড়িসহ সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া আগের মতো লাভ হয় না তাঁদের। সরকার যদি সহজ কিস্তিতে তাঁদের ঋণ বা আর্থিক সহায়তা দিত, তাহলে তাঁরা উপকার পেতেন। বাপ-দাদার এ শিল্পকে ধরে টিকে থাকতে পারতেন।

প্রতিটি ছোট ছুরি ৫০ থেকে ৮০ টাকা, বড় দা ও ছুরি ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, চাপাতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তৈরিসহ অন্যান্য খরচা বাদে জনপ্রতি রোজ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা তাঁদের আয় হয়। যা দিয়ে বর্তমান বাজারে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা বেশ কঠিন বলে জানালেন কামারেরা।

হোসেনপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহেল মিয়া বলেন, উপজেলার আড়াইবাড়িয়া কামারপল্লির ৩০০ পরিবারকে বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তারা যেন সহজে ঋণ দিতে পারে, সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।