বিএসটিআইয়ের পদ্ধতিটি সঠিক নয়

আহসান খান চৌধুরী, চেয়ারম্যান, প্রাণ
আহসান খান চৌধুরী, চেয়ারম্যান, প্রাণ
>

খাদ্যমান নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে। বিএসটিআইয়ের মান পরীক্ষায় প্রথম দফায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি ৫২টি পণ্য। এর মধ্যে তিনটি ছিল প্রাণ ও দুটি এসিআইয়ের। কেন মান রক্ষায় ব্যর্থতা, তা নিয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রাণ-আরএফএলের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ ও শুভংকর কর্মকার।

প্রথম আলো: প্রাণের পণ্যের মান নিয়ে অভিযোগ আগেও এসেছে। এবারও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডাস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মান পরীক্ষায় প্রাণের তিনটি পণ্য উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ অভিযোগকে অস্বীকার করবেন কীভাবে?

আহসান খান: বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প বড় হচ্ছে। দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও জানতে হবে, কীভাবে খাদ্যশিল্পের সঙ্গে কাজ করতে হয়। আমরা চাই, যদি আমাদের কোনো পণ্যে তারা তারতম্য পায়, তাহলে আমাদের জানাবে। আমরা তাদের কথা শুনব, সংশোধন করব। যেটা বিএসটিআই করেছে, সেটা খাদ্যশিল্পের জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়। আমরা দেশের মানকাঠামো পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করার দাবি করছি। আমরা সাম্প্রতিক ঘটনার পর পর্যালোচনা করে দেখেছি, বিএসটিআই পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোডেক্স (আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মান ও পরীক্ষার রীতি) অনুসরণ করছে না। আমরা মনে করি, উন্নত দেশে খাদ্যপণ্য পরীক্ষা করার যে রীতি রয়েছে, সেটা আমাদের দেশে আনা জরুরি। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের খাদ্যশিল্প ব্যাপকভাবে উন্নত। ওরা জানে কীভাবে খাদ্যশিল্পের সঙ্গে কাজ করতে হয়।

প্রথম আলো: সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই। এবার বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় প্রাণের হলুদের গুঁড়া, মিক্সড কারি পাউডার ও লাচ্ছা সেমাই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সেগুলো কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়?

আহসান খান: মোটেও ক্ষতিকর নয়।

প্রথম আলো: কেন ক্ষতিকর নয়?

আহসান খান: হলুদের গুঁড়ায় যে প্যারামিটারটিতে মান উত্তীর্ণ হয়নি, সেটা হলো ‘টোটাল অ্যাশ’। এ দেশের মানুষ খুব মিহি মসলা পছন্দ করে। আমরা উন্নত পালভারাইজার যন্ত্র দিয়ে হলুদের গুঁড়া তৈরি করি, তাতে মসলা মিহি হয়। এটা পরীক্ষার ক্ষেত্রে অ্যাশ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ওনারা কিন্তু বলছেন না যে আমাদের মসলায় বালু পেয়েছেন।

কারি পাউডার অনুত্তীর্ণ হয়েছে মাত্রার চেয়ে লবণ বেশি থাকায়। ভোক্তার চাহিদার কথা মাথায় রেখে আমরা লবণসহ একধরনের কারি পাউডার বাজারে ছেড়েছি, যাতে মাছ রান্না করলে আলাদাভাবে লবণ দেওয়া না লাগে। বিএসটিআইয়ের মানকাঠামোতে এটার সুযোগ নেই। এ অজ্ঞতা আমাদের ছিল।

প্রথম আলো: লাচ্ছা সেমাইতেও তো বিএসটিআই ফ্যাট বা চর্বি মাত্রার চেয়ে বেশি পেয়েছে। এটাও কি তাদের অজ্ঞতা?

আহসান খান: বাংলাদেশে সিংহভাগ ক্ষেত্রে লাচ্ছা সেমাই তৈরি হয় ডালডা দিয়ে। ডালডা দিয়ে তৈরি করলে সেমাইয়ে চর্বি বা ফ্যাট নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হবেই। ডালডা স্বাস্থ্যহানিকর কোনো উপাদান নয়। আমরা এই লাচ্ছা সেমাই যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি। অন্য কোনো দেশ চর্বির মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন করেনি। দেশের বাজারে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে সবাইকে বলে দিতে হবে যে ডালডা দিয়ে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করা যাবে না।

প্রথম আলো: বিদেশে রপ্তানির কথা বলছেন। বছর পাঁচেক আগে তো আপনাদের একটি হলুদের গুঁড়ার চালান কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত এসেছিল। আপনাদের কেনা আমে ফরমালিনও পাওয়া গিয়েছিল।

আহসান খান: আমাদের হলুদ সরবরাহ করেন কৃষকেরা। বিষয়টি নিয়ে আমরা ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে পেয়েছি, বিক্রির সময় হলুদে রং মেশানো হয়। ওই রঙে ছিল সিসা। এরপর আমরা ব্যাপক কার্যক্রম নিয়ে হলুদের গুঁড়া পুরোপুরি নিরাপদ করেছি। আর ফরমালিন যে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা হতো, সেটা ফল পরীক্ষার জন্য ছিল না। আদালতের নির্দেশে যন্ত্রটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। শুধু শুধু আমাদের দায়ী করা হয়েছিল।

প্রথম আলো: তরল দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। জবাব কী দেবেন?

আহসান খান: গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর পর দোহানো হলে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাবে। তবে আমরা দুধ সরকারি সংস্থার পরীক্ষাগারেই পরীক্ষা করিয়েছি। ক্ষতিকর মাত্রায় কিছু পাইনি।

প্রথম আলো: শুরুতে আপনি মানকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাহলে আপনি কি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মান বাংলাদেশে অনুসরণ করা হোক? সেটা মেনে আপনারা খাদ্য তৈরি করতে পারবেন?

আহসান খান: ঠিক তা-ই। আমরা চাই বাংলাদেশে কোডেক্স অনুসরণ করা হোক। পৃথিবীর অন্তত ১৪১টি দেশে কোডেক্স অনুসরণ করা হয়। কোডেক্স অনুসরণ করা হলে আমাদের মতো কোম্পানিগুলোকে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।

প্রথম আলো: আপনার বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।

আহসান খান: আমি দেশের আইনের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক। তবে যেদিনের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, সেটা আশা করিনি। পরের দিন আমি সশরীরে হাজির হয়ে জামিন পেয়েছি।

প্রথম আলো: খাদ্যমানের বাইরে একটা প্রশ্ন করি। দুবাই থেকে সিমেন্ট আমদানির ক্ষেত্রে কর ফাঁকির একটা অভিযোগ আপনাদের বিরুদ্ধে উঠেছে।

আহসান খান: আমরা প্লাস্টিক দানা আমদানির ঋণপত্র খুলেছিলাম, যার কেজি ১১০ টাকা। বিপরীতে সরবরাহকারী চুরি করার জন্য সিমেন্ট পাঠিয়ে দেন, যার কেজি মাত্র ১২ টাকা। সিমেন্ট দেখেই আমরা কাস্টমসে বলেছি, এই পণ্য নিতে রাজি নই। আদালতে গিয়ে টাকা পরিশোধের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়েছি। বাংলাদেশে আরও তিনটা কোম্পানি ওই সরবরাহকারীর চুরির শিকার হয়েছে। আমরা খুবই হতভাগ্য দেশের বাসিন্দা। এখানে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারছি না যে আমরা চুরির শিকার। উল্টো নিজেদের চোর বানাতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।