কৃষক খুঁজে ঋণ দিচ্ছে কৃষি ব্যাংক

আবারও কৃষকের কাছে ফিরতে শুরু করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। নতুন নতুন কৃষককে খুঁজে বের করে ৯ শতাংশ সুদে তাঁদের ঋণসুবিধা দিচ্ছে। এ জন্য নতুন প্রকল্পও হাতে নিয়েছে ব্যাংকটি। এর মাধ্যমে হাসি ফুটছে লাখো কৃষকের মুখে।

ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে নতুন কয়েকজন গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে তাঁদের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। এমনই একজন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুরের আবুল খায়ের। আলু চাষের জন্য ২০১৮ সালে স্থানীয় কৃষি ব্যাংক থেকে প্রথমবারের মতো এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। 

আবুল খায়ের বলছিলেন, ‘ভাই, কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই প্রথমবারের মতো কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। সুদের হারও অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম। এ জন্য ভয়েও নাই। অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিলে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হয়।’ 

এমনই আরেক কৃষক সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শওকত হোসেন। তিনি মাছের ঘেরের জন্য কৃষি ব্যাংক থেকে দুই দফায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন। মুঠোফোনে শওকত হোসেন বলেন, ‘মাছের চাষ করি। মিষ্টির দোকান আর গ্যারেজও আছে। কৃষি ব্যাংকের ঋণের সুদ কম, তাই শোধ দিতেও সমস্যা হয় না।’ 

তবে ব্যাংকটি যে নতুন গ্রাহকদের তালিকা প্রদান করেছিল, তার সবাই যে নতুন তা নয়। কয়েকজন আগে থেকে ঋণসুবিধা নিয়ে আসছিলেন। আবার অনেকে অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছিলেন। 

ব্যাংকটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৩৯৫ জন নতুন কৃষককে ২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে এই ব্যাংক কৃষি খাতে মোট ৬ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে কৃষি খাতে মোট ২৩ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন, বিশেষায়িত ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয় ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে।

ব্যাংক সরাসরি কৃষিঋণ দিলে সুদের হার হয় ৯ শতাংশ। অথচ এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ দিলে সুদহার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারপরও এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণেই প্রাধান্য দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ, এতে ব্যাংকের কোনো কার্যক্রম থাকে না, ফলে খরচও কম। এখানেই ব্যতিক্রম বিকেবি। তারা সরাসরি কৃষকের কাছে ঋণ পৌঁছে দিচ্ছে। ঋণ পাননি এমন কৃষককেও খুঁজছে তারা। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত মে মাসে কৃষি ও পল্লি পরিসংখ্যান জরিপের ফল প্রকাশ করে। এতে উঠে এসেছে, কৃষকেরা যে পরিমাণ ঋণসুবিধা পান, তার ৬৩ শতাংশের জোগান দিচ্ছে এনজিও। মাত্র ২৭ শতাংশ যাচ্ছে ব্যাংক খাত থেকে। আর মহাজন ও আত্মীয়স্বজন থেকে ধারকর্জ করেন ১০ শতাংশ কৃষক। 

সেই জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশের ২ কোটি ৭৪ লাখ ৮০ হাজার ৫৪টি পরিবারের মধ্যে ১ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৫টি পরিবারই কৃষির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃষি পরিবার ঢাকা বিভাগে, এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপর বেশি কৃষি পরিবার রয়েছে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে। 

জানতে চাইলে বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষকের হাতে সরাসরি ঋণ পৌঁছে দেওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। যেসব কৃষক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণসুবিধা না পেয়ে বেশি সুদে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছেন, তাঁদের কাছে আমরা ঋণ পৌঁছে দিতে চাই। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি লক্ষ্য পূরণ হবে। দেশও এগিয়ে যাবে।’ 

আলী হোসেন প্রধানিয়া আরও বলেন, ‘দেশ কৃষিনির্ভর। আর কৃষি ব্যাংক হবে শুধু কৃষকদের জন্য। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।’ 

শুধু পৌনে দুই লাখ কৃষককে নতুন ঋণ দেওয়াই নয়, পাশাপাশি বিকেবি গত অর্থবছরে প্রায় চার লাখ নতুন আমানতকারীও তৈরি করেছে। ফলে নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটি যে খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছিল, সেখান থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমে নেমে এসেছে ১৭ শতাংশে, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২১ শতাংশ। 

ব্যাংকটির এখনো বড় মাথাব্যথার কারণ কয়েকটি বড় খেলাপি গ্রাহক। এর মধ্যে ফেয়ার ইয়ার্নের খেলাপি ঋণ ৩১৩ কোটি টাকা, আনিকা ট্রেডার্সের ১০১ কোটি, এস এ অয়েলের ৮৬ কোটি ও রহমান ট্রেডিংয়ের ৬২ কোটি টাকা। 

খেলাপি ঋণ আদায়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা আয়োজন ব্যাংকটির একটি নিয়মিত উদ্যোগ। এর মাধ্যমে গত অর্থবছরে ব্যাংকটি ৫৭৪ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছিল। 

বিকেবির আরেকটি সাফল্য হলো প্রবাসী আয় আনা। গত অর্থবছরে ব্যাংকটির মাধ্যমে দেশে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি। এত সব অর্জন সম্ভব হয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ৩৭টি শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে।