বগুড়ায় পানির দরে চামড়া বিক্রি

লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। চকযাদু সড়ক, বগুড়া, ১২ আগস্ট। ছবি: সোয়েল রানা
লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। চকযাদু সড়ক, বগুড়া, ১২ আগস্ট। ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ায় ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এলাকা ভেদে ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকার ওপরে কেনা গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। পানির দামের চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে ছাগলের চামড়া। ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়।

স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, ৪০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে কম দামে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে। ট্যানারি-মালিকদের নির্ধারণ করে দেওয়া দরের এক-তৃতীয়াংশ দামও মিলছে না চামড়ার। অনেক এলাকায় চামড়ার ক্রেতাই পাওয়া যাচ্ছে না। কম দরে চামড়া বিক্রি হওয়ায় দরিদ্র প্রতিবেশী, এতিমখানা, মাদ্রাসা প্রাপ্য অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এত কম দর হওয়ার কারণ হিসেবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন বিক্রেতারা। এদিকে কম দরে বেচাকেনা হওয়ায় চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতবার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ঢাকায় ৪৫ থেকে ৫০ এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম নির্ধারিত হয় ১৮ থেকে ২০ এবং ছাগলের চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা। এই দরে ৩০ থেকে ৩৫ বর্গফুটের লবণযুক্ত বড় গরুর চামড়া ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকায় ট্যানারি-মালিকদের কেনার কথা। প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে লবণ, গুদাম ভাড়া, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ মোট ব্যয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা এবং ১০০ টাকা মুনাফা ধরলেও ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় মাঠপর্যায়ে কেনাবেচা হওয়ার কথা। কিন্তু চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ১৫ থেকে ২৫ বর্গফুটের ছোট ও মাঝারি চামড়ার যৌক্তিক দাম ১ হাজার টাকা হলেও ৫০০ টাকার বেশি দরে কোথাও চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। নির্ধারিত দরের হিসাবে গড়ে ১০০ টাকায় ছাগলের চামড়া বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে।

ঈদ উপলক্ষে বগুড়ার প্রধান চামড়ার বাজার বসে থানা মোড় থেকে চকযাদু সড়ক হয়ে চামড়া গুদাম লেন পর্যন্ত। ভালো দামের আশায় অনেক দূর থেকে বগুড়ার এই বাজারে চামড়া বিক্রি করতে এলেও বিক্রেতারা অনেকেই রিকশা ভাড়ার টাকাও উঠাতে পারেননি। তখন তাঁরা রাগে ও ক্ষোভে চামড়া ফেলে রেখে গেছেন। থানা মোড় থেকে শুরু করে বাদুড়তলা চামড়া গুদাম লেনের আড়ত পর্যন্ত চামড়া কিনেছেন শত শত আড়তদার। সবাই আগেভাগে ঠিক করে নিয়ে একই দরে কিনেছেন। এ কারণে আড়ত থেকে আড়তে ঘুরেও দাম পাননি বিক্রেতা আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কম দাম জানাজানি হওয়ার পর অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী চামড়া কিনতে বের হননি। চামড়া বিক্রি করতে না পারায় অনেকেই ছিলেন ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বিভিন্ন মহল্লা থেকে একসঙ্গে অনেক চামড়া আড়তে নিয়ে এলেও ছোট-বড় মিলিয়ে গড় দর ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি পাননি বিক্রেতারা।

চকযাদু সড়কে একটি গরু ও একটি ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে এসেছিলেন সুলতানগঞ্জ পাড়ার মিজানুর রহমান। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘পশু জবাই করে সকাল থেকে বসে আছি। অন্যবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনতেন। এবার ক্রেতার দেখা নেই। আড়তে এনেও চামড়া কেনার লোক নাই। ৯০ হাজার টাকার গরুর চামড়া শেষমেশ ৪০০ টাকায় এবং ১৫ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া ১৫ টাকায় বিক্রি করেছি।’

চেলোপাড়ার আতিক মোহাম্মদ শামীম সকাল থেকে পশু কোরবানি দিয়ে চামড়া নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দুপুরের দিকে একজন ক্রেতা আসেন চামড়া কিনতে। অনেক অনুরোধের পর ৭০ হাজার টাকার গরুর চামড়া ৫০০ এবং ১০ হাজার টাকার ছাগলের চামড়া মাত্র ১৫ টাকায় কিনতে রাজি হন। উপশহর এলাকার রবিউল করিম নামের এক বিক্রেতা দুপুরের দিকে চকযাদু সড়কে ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে আসেন। ২০ হাজার টাকার ছাগলের চামড়ার দাম পান মাত্র ২০ টাকা। ক্ষুব্ধ রবিউল বলেন, এবার বাড়িতে গিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দাম বলেন ১৫ টাকা। ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে আড়তে এনে দাম পেয়েছি ২০ টাকা।

চামড়ার বাজারমূল্যে নজিরবিহীন ধস দেখে অনেকেই পানির চেয়েও এবার পশুর চামড়ার দাম কম বলে মন্তব্য করেছেন। পশুর চামড়া বিক্রির জন্য অনেক স্থানে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো এলাকায় গরুর চামড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকাতেও কেনাবেচা হয়েছে। গরুর চামড়ার সঙ্গে ছাগলের চামড়া ফ্রি দিতে হয়েছে কোথাও কোথাও। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ভোগান্তির চিত্র ছিল সর্বত্র।

বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ীদের একাধিক নেতা জানান, প্রতিবছর ট্যানারি-মালিকেরা কোরবানির আগে বগুড়ার পাইকারি ব্যবসায়ীদের বকেয়া পরিশোধ করতেন। কোরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি-মালিকেরা আগাম পুঁজিও দিতেন। কিন্তু এবার ট্যানারি-মালিকেরা মাঠের ব্যবসায়ীদের খোঁজ নেননি, আগাম পুঁজি দূরে থাক; শত কোটি টাকার বকেয়াও পরিশোধ করেননি। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই পুঁজি নিয়ে ঈদের দিনে পশুর চামড়া কেনার জন্য মাঠে নামতেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুঁজি না পেয়ে এবার নিজের স্বল্প পুঁজিতে চামড়া কেনেন তাঁরা। পুঁজি সংকটের কারণে অনেক এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার ধারেকাছেও ঘেঁষেননি।

মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী বাবুলাল রবিদাস প্রথম আলোকে বলেন, শহর-গ্রাম সব খানেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। এবার সবচেয়ে ভালো মানের চামড়াও কেনা হচ্ছে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রতি কোরবানির ঈদে চামড়া ব্যবসা করছি। অতীতে আর কোনো ঈদে এত সস্তায় চামড়া কেনাবেচা হয়নি।

বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছর ৮০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি করেছি ১ হাজার টাকায়। এবার বিক্রি করতে হয়েছে ৪০০ টাকায়।

বিক্রেতারা বলছেন, অন্য বছর কোরবানির পশু জবাই করার পরপরই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া কিনতেন। এবার পশু জবাই করার পর দিনভর ক্রেতার অপেক্ষায় থাকলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা মেলেনি।

জানতে চাইলে জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির একজন নেতা বলেন, ট্যানারি-মালিকদের কাছে বগুড়ার ব্যবসায়ীদের পাওনা ১০০ কোটি টাকা। ঈদের আগে সেই বকেয়া পাওনা পরিশোধ করেননি মালিকেরা। তাই এবার চামড়া কিনতে পুঁজি সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অগ্রিম পর্যাপ্ত টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে এবার চামড়ার দাম কম।