চামড়ার দামে ধস, কার লাভ-কার ক্ষতি?

কোরবানির চামড়া বা বিক্রি করা অর্থ দান করতে হয়। এই দান এতিমখানা, মাদ্রাসা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীই পেয়ে থাকে। কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীই এ সময় আয় করেন। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। চামড়ার দাম পেয়ে যাদের উপকৃত হওয়ার কথা তারা এবার তা পাচ্ছেন না। বলা যায় পুরো লাভটাই যাচ্ছে আড়তদার, ব্যবসায়ী আর ট্যানারি মালিকদের পকেটে।

অবশ্য ট্যানারি মালিকেরা বলছেন, আড়তদারেরা নিজেরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে। এতে তারাই লাভবান হবেন। আর আড়তদারদের অভিযোগ ট্যানারি মালিকেরা গতবারের চামড়ার দাম পরিশোধ না করায় এবার বেশির ভাগ আড়তদার বা ব্যবসায়ী চামড়া কেনা থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে চামড়ার দাম কমে গেছে।

এ বছর ঈদে কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা ছিল প্রায় এক কোটি ১০ লাখের মতো। এ জন্য প্রায় ৪২ লাখ গরু প্রস্তুত ছিল। বাকিটা ছাগল ও মহিষ কোরবানি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়ার বাজারে ধস নামার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং এখন কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নেবে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা। তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন লাভ যাবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদেরই পকেটে। চামড়া রপ্তানি হলে ট্যানারি মালিকেরা তখন আর কম দামে এদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে পারবেন না।

গতকাল সোমবার থেকে দেশের চামড়ার বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা গেছে। লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র তিন শ টাকায়। যাঁরা কোরবানি দিয়েছেন, তাঁরা যেমন চামড়ার দাম পাননি, তেমনি দাম পাচ্ছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, সিন্ডিকেটের কারণেই বাজারের এ অবস্থা।
গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চামড়ার অস্থায়ী বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি ছোট চামড়ার দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং বড় চামড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম গত বছরের তুলনায় অর্ধেক।

রাজধানীর পোস্তা এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে তাতে লবণ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা, ১৩ আগস্ট। ছবি: ফোকাস বাংলা
রাজধানীর পোস্তা এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে তাতে লবণ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা, ১৩ আগস্ট। ছবি: ফোকাস বাংলা

রাতে এসে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করে। আড়াই শ তিন শ টাকার বেশি কোনো চামড়া বিক্রি হয়নি। সারা দেশেও পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। ঈদের দ্বিতীয় দিন রাজধানীর পোস্তার চামড়ার আড়ত এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় চামড়ার বাজার আরও খারাপ পর্যায়ে নেমে যায়। পোস্তায় দেড় শ দু শ টাকায় চামড়া বিক্রি করতেও কষ্ট হয়েছে। বিক্রি না হওয়া চামড়া পোস্তার সড়কে পচে নষ্ট হতে দেখা গেছে।

আজ দুপুরে পোস্তার আড়তে দেখা হয় নরসিংদীর ব্যবসায়ী হাসান মিয়ার সঙ্গে। বেশি দাম পাওয়ার আশায় ১৮৪টি চামড়া নিয়ে সেখানে এসেছিলেন। সকাল থেকে আড়তে আড়তে ঘুরে সঠিক দাম না পেয়ে ফিরে গেছেন তিনি। এই প্রান্তিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে জানান, তিন শ থেকে ৫শ টাকায় চামড়া কিনেছেন। প্রতিটি চামড়ার পেছনে খরচ হয়েছে আরও দু শ টাকা করে। কিন্তু বিক্রি করতে এসে প্রতিটি চামড়া আড়াই শ টাকার বেশি দিতে চায়নি কেউ। তাই ফেরত নিয়ে গেছেন।

একই অবস্থা রূপগঞ্জ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের। তাঁর দাবি, লবণযুক্ত চামড়াও নির্ধারিত দামে কিনতে রাজি হননি আড়তদারেরা। এ রকম অবস্থা অনেক ব্যবসায়ীর। এঁদের কেউ চামড়া নিয়ে নিজ এলাকায় ফেরত গেছেন। আবার কেউ রাস্তাতেই ফেলে গেছেন।
প্রথম আলোর চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সেখানে ৩০০ টাকার চামড়া ৫০ টাকায়ও কিনতে রাজি হননি। চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম নগরের আতুরার ডিপো চামড়ার আড়তে হাটহাজারী উপজেলা থেকে ছয় শ চামড়া নিয়ে এসেছেন দিদার আলম। এসব চামড়া বিক্রির জন্য আড়তদারদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিচ্ছিলেন এই মৌসুমি ব্যবসায়ী। কিন্তু এগুলোর কেনার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ নেই আড়তদারদের। পরে হতাশ হয়ে সড়কের ওপর ফেলে বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করেন তিনি। একই অবস্থা দিদার আলমের মতো অন্যান্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরও। ৩০০-৪০০ টাকা দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এখন ৫০ টাকা দিয়েও তা বিক্রি করতে পারছেন না।
সেখানকার কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীরা জানান, এবার কোরবানির চামড়ার বাজারকে কেন্দ্র করে পাইকারি চামড়া ক্রেতা এবং আড়তদারের প্রতিনিধিরা মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাঁদের লোকজন কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় গিয়ে চামড়া সংগ্রহ শুরু করে। অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক কম দরদাম করায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই এতিমখানায় চামড়া দান করেছেন। চামড়ার প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ার কারণে তারা কাঁচা চামড়া এতিমখানায় দিয়েছেন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা এতিমখানা থেকে সরাসরি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন।

চামড়ার বাজারের এই অবস্থা সারা দেশেই। গরু বা মহিষের চামড়ার দাম সামান্য মিললেও ছাগলের চামড়া কেউ ধরে দেখছেন না। কিছু কিছু এলাকা থেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার খবরও এসেছে।
এরই মধ্যে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে কথা জানিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল লতিফ বকসী এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, চামড়ার উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না। এ বিষয়ে চামড়াশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ন্যায্য দাম না পেয়ে কোরবানির পশুর ৯০০টি চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, ১৩ আগস্ট। ছবি: সংগৃহীত
ন্যায্য দাম না পেয়ে কোরবানির পশুর ৯০০টি চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, ১৩ আগস্ট। ছবি: সংগৃহীত

সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, এর ফলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, এর ফলে এই শিল্প বেঁচে যাবে।

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এর মাধ্যমে এ শিল্পের কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে সেটা বিবেচনা করা জরুরি। চামড়ার বাজারে ধস কেন সেটা বিচার না করে হুট করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকরী হবে কম না সেটা ভাবতে হবে। কাঁচা চামড়া যদি রপ্তানি করা হয় তাহলে ট্যানারিগুলো পর্যাপ্ত চামড়া পাবে কম না? এতে এ শিল্পের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কি না সেটা বিবেচনা করতে হবে।

চামড়ার দরপতন নিয়ে গতকাল থেকেই সিন্ডিকেটের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কারা জড়িত সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। সিন্ডিকেটের কারণে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কোরবানি চামড়ার অর্থ যাদের পাওয়ার কথা সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কম দামে চামড়া কিনছেন আড়তদারেরা। এই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলছেন, দু শ আড়াই শ টাকায় যেসব চামড়া আড়তদারেরা কিনেছেন সেগুলো তাঁরা ট্যানারি মালিকদের কাছে বড় লাভে বিক্রি করবেন। প্রতিটি চামড়ার পেছনে একজনের খরচ হবে সর্বোচ্চ দু শ টাকা। আর আকার ভেদে সরকার নির্ধারিত দামে এসব চামড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি হবে এক হাজার পাঁচ শ থেকে দুই হাজার টাকায়। রপ্তানির অনুমতি পাওয়ায় ট্যানারি মালিকেরা এখন আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম দামে চামড়া পাবে না।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে এবার এক কোটিরও বেশি চামড়া সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মধ্য গড়ে প্রতিটি গরুর চামড়া থেকে গড়ে ৮০০ টাকা লাভ করার সুযোগ পাবেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, আড়তদারেরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ আজ প্রথম আলোকে এ অভিযোগ করেছেন। তবে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে আমাদের বকেয়া প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। অনেকেই টাকা পাননি। আমাদের প্রায় আড়াই শ আড়তদারের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জন চামড়া কিনতে পারছেন। তাই বাজারে ক্রেতা কম। আর তাতে দাম পড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশি দামে চামড়া কিনছেন। না বুঝে ব্যবসা করতে এসে আড়তদারদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাঁরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।’

সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। সংকুচিত হয়ে পড়েছে সড়ক। এতে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো। ছবি: জুয়েল শীল
সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। সংকুচিত হয়ে পড়েছে সড়ক। এতে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো। ছবি: জুয়েল শীল

বাজারে ধস আর সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যদি ধরে নেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিচ্ছে তাহলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কি করছেন? এর পেছনে কোনো চক্র যদি কাজ করে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে তাতে বোঝা যাচ্ছে, বাজার পর্যবেক্ষণ ঠিকমতো হয়নি।

আরও পড়ুন: