শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত : রপ্তানি না করেই তাঁর রপ্তানি আয় ১৭৪ কোটি টাকা

টেরাকোটা টাইলস রপ্তানির নামে ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ১৭৪ কোটি টাকা তুলে নেন এসবি এক্সিম বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহজাহান বাবলু। অথচ কোনো পণ্যই রপ্তানি হয়নি। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে তিনি ওই টাকা বিদেশে পাচার করেন। আবার ব্যাংকের মাধ্যমে সেটা ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অর্থ পাচারের অভিযোগে শাহজাহান বাবলু ও সহযোগী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শিগগিরই মামলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে অভিযোগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাসপোর্ট–সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসবি এক্সিম বাংলাদেশের সহযোগী ৭টি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা-সম্পর্কিত তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি গেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে চিঠি দিয়ে ২২৪টি শিপিং বিলের পণ্য রপ্তানি তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে।

গত ১৮ জুলাই ‘টেরাকোটা টাইলসে টাকা পাচার’ শিরোনামে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অনুসন্ধানে নেমেই সংস্থাটি এসবি এক্সিম বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে চিঠি দিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। শাহজাহান বাবলু, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ৯ কর্মকর্তার মধ্যে ৮ জন এবং ৩ জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে শুনানির জন্য ডেকে নেয়।

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র বলছে, যেসব রপ্তানি বিলের বিপরীতে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানি করা হয়নি বলে এসবি এক্সিম লিখিতভাবে স্বীকার করেছে। ঋণ নেওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও সঠিক নয়।

প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের স্বীকারোক্তিমূলক চিঠির তথ্য অনুসারে দেখা গেছে, তারা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ১৭৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে, যা বর্তমানে সুদে–আসলে ১৯৮ কোটি টাকা হয়েছে। ওই ১৭৪ কোটি টাকা দিয়ে তারা ঋণ পরিশোধ এবং অন্য প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। তথ্যমতে, ওই টাকা দিয়ে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় ৪৮ কোটি ২ লাখ, কৃষি ব্যাংকের স্থানীয় মুখ্য কার্যালয়ে ২২ কোটি ৭৭ লাখ, ইসলামী ব্যাংক প্রধান কার্যালয় কমপ্লেক্স শাখায় ১৬ কোটি ৩৯ লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংক দিলকুশা করপোরেট শাখায় ২ কোটি ৫৫ লাখ, ইউসিবিএল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় ১ কোটি ৭ লাখ টাকাসহ মোট ৯০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঋণ শোধ করেছে।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ওই ঋণের টাকা দিয়ে আমদানি বাবদ ১২ কোটি ৪৫ লাখ, বন্দর থেকে মালামাল ছাড় করা বাবদ ২ কোটি ২৮ লাখ, ৩টি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন নির্মাণ বাবদ ১০ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত ঋণ বাবদ ২৬ কোটি টাকা, জমি কেনা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বাবদ ৫ কোটি টাকা, স্থানীয় বাজার থেকে মালামাল কেনা বাবদ ২৭ কোটি টাকাসহ ৮২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
এ হিসাবে মোট ১৭৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা খরচ করার কথা তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শুল্ক গোয়েন্দা নিশ্চিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে রপ্তানি না করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। অবৈধভাবে ঋণ নিয়ে সে অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেছে। অবৈধভাবে অর্জিত ওই অর্থ বৈধ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে।

এসবি এক্সিম ১০টি টিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দিলকুশা শাখার সহায়তায় আড়াই লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় দুই কোটি টাকা) এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটায় বিদেশে পাচার করেছে।
৬৪টি রপ্তানি বিলের বিপরীতে ১ কোটি ৪ লাখ ২৭ হাজার মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৮৭ কোটি ৪১ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ টাকা দেশে এসেছে। সেই টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। রপ্তানি না হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানির বিপরীতে টাকা ফেরত আসায় স্পষ্টতই প্রমাণ হয়, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে সে টাকা রপ্তানি মূল্য হিসেবে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
অনুসন্ধান আরও বলছে, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাব দেওয়ার পর দিন দিনই ঋণ অনুমোদন হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এসবি এক্সিম বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন।

সূত্র জানায়, কমার্স ব্যাংকের তৎকালীন এমডি (কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি) আর কিউ এম ফোরকান শুল্ক গোয়েন্দায় শুনানিতে দাবি করেছেন, শাখা অফিস, ট্রেড ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সুপারিশ ও বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। তিনি ট্রেড বিভাগের প্রধান কাজী রেজাউল করিম ও আফজাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
ট্রেড বিভাগের প্রধান কাজী রেজাউল করিম ও আফজাল হোসেন শুনানিতে বলেছেন, ওপর থেকে (বিশেষ করে পরিচালকদের) চাপ থাকার কারণে সব শর্ত পূরণ না করার সত্ত্বেও ঋণ অনুমোদন হয়েছে। ঋণ প্রস্তাবে সব বিবরণ থাকার পরও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। ওই বিভাগের অন্য দুই কর্মকর্তা জামাল হোসেন ও শাহিনুজ্জামান বলেছেন, তাঁরা যথাযথভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ ও বিরাগভাজনের ভয়ে কাজ করেছেন।

দিলকুশা শাখার ব্যবস্থাপক ফকির নাজমুল আলম শুনানি বলেছেন, রপ্তানি শুরুর দিকে টাকা ফেরত আনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নির্ভরযোগ্যতা তৈরি করে, যা তাঁরা বুঝতে পারেননি। তিনি বলেছেন, সুইফট-এ ৭ কোডের ম্যাসেজ, ঋণপত্রের ম্যাসেজ ইত্যাদি পাওয়ার পর প্রধান কার্যালয়ে ঋণ অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা শাখার নেই। শুল্ক গোয়েন্দার ওই শুনানিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলমকে হাজির হতে বলা হলেও তিনি হাজির না হয়ে আইনজীবীকে পাঠান। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি তাঁর বক্তব্য দেন।
পুরো অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষে শুল্ক গোয়েন্দা বলছে, রপ্তানির নামে অর্থ আত্মসাৎ, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিদেশে অর্থ পাচার, রপ্তানি না হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ আনা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অপরাধ সংঘটন—সব কটিই মানি লন্ডারিং আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধ। সে কারণে এসবি এক্সিম বাংলাদেশের মালিক শাহজাহান বাবুল ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে প্রতিষ্ঠানটি।

সূত্র জানিয়েছে, অনুসন্ধান প্রতিবেদন এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদনের জন্য পাঠানোর কথা। বোর্ডের চেয়ারম্যানের অনুমোদন পেলেই মামলা হওয়ার কথা। সূত্রমতে, আগামী সপ্তাহেই এ মামলা হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহিদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, বিষয়টির অনুসন্ধান অনেকখানি এগিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: