সরকার আগে রপ্তানির ঘোষণা দিলে এমন বিপর্যয় হতো না

আবদুল কাদের
আবদুল কাদের
কোরবানির পশুর চামড়ার দামে ব্যাপক ধস নেমেছে। কেন ধস নামল এবং বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করণীয় বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকারসুজন ঘোষ


প্রথম আলো: চট্টগ্রামে এক লাখ চামড়া রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেল। এর দায়ভার কার?

আবদুল কাদের: আমি তো মনে করি, চামড়া নষ্ট হওয়ার জন্য মূলত দায়ী ট্যানারির মালিকেরা। তাঁরা অনেক দিন ধরে আমাদের পাওনা ৫০ কোটি টাকা দিচ্ছেন না। ফলে এবার অনেক আড়তদার চামড়া কিনতে পারেননি। সমিতির ১১২ সদস্যের ৮০ শতাংশই চামড়া কেনেননি। মাত্র ২০ শতাংশ সদস্য চামড়া কিনেছেন। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। চামড়াগুলো রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে।

প্রথম আলো: আপনারা চামড়া কিনলেন না কেন?

আবদুল কাদের: আমাদের কাছে যে পুঁজি ছিল, তা পুরোপুরি ট্যানারির মালিকদের কাছে আটকে আছে। এখন মূলধন নেই। লবণ কেনার টাকা নেই। টাকা না থাকলে আড়তদারেরা চামড়া কিনবেন কী করে। আড়তদারেরা যেহেতু এবার খুব একটা চামড়া কেনেননি, তাই বাজারে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

প্রথম আলো: অন্য আড়তদারেরা তাহলে কীভাবে চামড়া সংগ্রহ করলেন?

আবদুল কাদের: ঢাকার ট্যানারির মালিকদের কাছ থেকে যাঁরা ক্রয়াদেশ পেয়েছেন, তাঁরাই শুধু চামড়া কিনেছেন। অন্যরা পুঁজি হারানোর ভয়ে ছিলেন। তাই চামড়া নেননি।

প্রথম আলো: তাহলে আপনাদের কোনো দায় নেই? অভিযোগ আছে, আড়তদারদের সিন্ডিকেটের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

আবদুল কাদের: আমাদের কোনো দায় নেই। একমাত্র দায়ী ট্যানারির মালিকেরা। আমাদের টাকায় তাঁরা হলেন হিরো। আমরা হলাম জিরো। আমাদের টাকা দিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছেন। আমরা কীভাবে সিন্ডিকেট করব? চামড়া পচনশীল দ্রব্য। দুই মাসের মধ্যে বিক্রি করতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই।

প্রথম আলো: প্রতিবছর চামড়াজাত পণ্য ও কোরবানির গরুর দাম বাড়ছে। কিন্তু চামড়ার দাম কেন কমছে?

আবদুল কাদের: এটি আমরা বলতে পারব না। অনেকেই বলছেন, বিশ্ববাজারে মন্দা চলছে। বিশ্বজুড়ে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার কমেছে। যাক, আমরা আদার ব্যাপারী; জাহাজের খবর রেখে লাভ নেই।

প্রথম আলো: এই পরিস্থিতি এড়ানোর উপায় ছিল না?

আবদুল কাদের: এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে ট্যানারির মালিকেরা আমাদের সঙ্গে যে খেলা খেলছেন, তার অবসান দরকার। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হবে। যদি কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যায়, তাহলে এই শিল্পের আরও উন্নতি হবে। আমরাও উন্নতি করব।

প্রথম আলো: কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কীভাবে দেখছেন?

আবদুল কাদের: সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এতে আমাদের অনেক উপকার হবে। বিশেষ করে ট্যানারির মালিকেরা চামড়ার দাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে পারবেন না। তাঁরা সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যে চামড়া কিনবেন। আর চামড়া রপ্তানির সুযোগ থাকায় এখন তাঁদের শরণাপন্ন হতে হবে না। এখন তাঁরা বাধ্য হয়ে চামড়া কিনবেন। কেননা চামড়া বাইরে রপ্তানি হোক, তা ট্যানারির মালিকেরা চাইবেন না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা যদি আরও আগে দেওয়া হতো, তাহলে এত চামড়া নষ্ট হতো না। তখন আমরা মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চামড়া কিনে রেখে দিতাম। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না।

প্রথম আলো: তার মানে, আপনারা চাইলে কিনতে পারতেন।

আবদুল কাদের: আমাদের টাকা আবার ট্যানারির মালিকদের কাছে আটকে যায় কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। তাই এবার আর চামড়া কিনতে খুব একটা আগ্রহী হইনি। আবার সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কিনবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কেননা ট্যানারি সমিতি কোনো দর বেঁধে দেয়নি। তারা যদি আগেভাগে একটা দর নির্ধারণ করে দিত, তাহলেও আমরা চামড়া কেনার সাহস পেতাম। আমাদের অনেকে ভেবেছে, সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ট্যানারির মালিকেরা তার চেয়ে কম দামে চামড়া কিনবেন। তাই ভয়ে বেশির ভাগ আড়তদার চামড়া কেনেননি।

প্রথম আলো: আপনারা বারবার পাওনা টাকার কথা বলছেন। সেই টাকা আদায়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আবদুল কাদের: ট্যানারির মালিকেরা আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিলেও কোনো কাগজপত্র দেন না। শুধু একটি সাদা কাগজে লিখে দেন। যদি তাঁরা আমাদের চেক দিতেন, তাহলে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারতাম। এখন সে সুযোগও নেই। 

প্রথম আলো: কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। অথচ এত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চলছে কেন?

আবদুল কাদের: এই ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে হলে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। বর্তমানে যেভাবে ব্যবসা হয়, তাতে দেখা যাবে, একজন আড়তদার মারা গেলে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কারও কাছ থেকে কোনো বকেয়া টাকা ফেরত পাবেন না। আবার ট্যানারির মালিকদের কেউ যদি মারা যান, তাহলেও আড়তদারেরা টাকা ফেরত পাবেন না। এই রকম ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। তাই আমি মনে করি, এ ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। তাই সরকারের পক্ষ থেকে কিছু নিয়মনীতি বেঁধে দেওয়া উচিত। তাহলে হয়তো পাওনা টাকা আদায়ের একটা বন্দোবস্ত হবে।

প্রথম আলো: চামড়া বিক্রির জন্য ঢাকার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানোর উপায় কী?

আবদুল কাদের: চট্টগ্রামে তিন-চারটি ট্যানারি চালু করা গেলে ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হবে না। চট্টগ্রামের বাইরে বিক্রি করতে হবে না। এ জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।