পরীক্ষার সামনে চট্টগ্রাম বন্দর

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দুই বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি দূর করতে ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের একটি প্রতিনিধিদল। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার পক্ষে এসব নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। 

সরেজমিন ঘুরে সম্প্রতি দেখা গেছে, ১৬ দফার মধ্যে মানুষ ও যানবাহন আসা-যাওয়ার ফটকে উন্নত মানের নিরাপত্তাব্যবস্থা স্থাপনসহ কয়েকটি নির্দেশনা বাস্তবায়নে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বটে, তবে কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। পুরো বন্দর এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা হয়নি। কনটেইনার খুলে আমদানি পণ্য খালাসের ব্যবস্থাটি বন্দরের ভেতর থেকে বাইরে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও তাতে তেমন অগ্রগতি নেই। ফলে প্রতিদিন ১০-১২ হাজার মানুষ বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় যাতায়াত করে, যা বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 

এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪২টি স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের প্রতিনিধিদলটি আবারও বাংলাদেশে আসছে। তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলটি আগামী শনিবার এসে পৌঁছার কথা। তারা আগামী রোববার ও সোমবার সরেজমিনে বন্দর, বিভিন্ন ডিপোসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করবে। তাদের চোখে বন্দরের নিরাপত্তায় কোনো ঘাটতি ধরা পড়লে পণ্য পরিবহনে বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। সেটি হলে বন্দরে জাহাজ আগমন থেকে শুরু করে বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর বন্দর ও জাহাজীকরণ–বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বন্দরের নিরাপত্তা বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। কারণ, এর সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য জড়িত। 

জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, বর্তমানে বন্দরের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় কোনো ঘাটতি নেই। নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করতে বন্দরের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নাধীন আছে। পণ্য খালাসের পদ্ধতি বন্দরের বাইরে নেওয়ার জন্য বে টার্মিনালে ইয়ার্ড নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

বন্দরের যেসব নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৪ সালের ১ জুলাই। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতিসংঘের অধীন আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা বিভিন্ন বন্দরের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যবস্থা বা আইএসপিএস কোড (জাহাজ ও বন্দর স্থাপনার নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম) প্রণয়ন করে। জাহাজ বা কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা না হয়, সে জন্যই এই নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪৮টি দেশের বন্দরে তা বাস্তবায়িত হয়েছে।

বাংলাদেশে আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত কমিটির প্রধান সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিধিদলটি নিরাপত্তার যে বিষয়গুলো দেখতে চেয়েছে, তা উন্নত করে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে। এক দিনে সব পরিবর্তন হয়তো করা যাবে না, তবে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। 

পর্যবেক্ষণ: আন্তর্জাতিক বন্দর নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০১৭ সালের ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি। তাদের ১৬ দফা পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, বন্দরের মাত্র ৩০ শতাংশ এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। সীমানাদেয়াল তদারকির জন্য ক্যামেরা নেই। সন্দেহজনক ছাড়া গাড়ি বা যানবাহন দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই করা হয় না। বন্দরে কনটেইনার খুলে পণ্য খালাসের কারণে বিপুলসংখ্যক গাড়ি ও লোকজন ঢুকে নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করছে। খালি কনটেইনারে ঢুকে মানুষের বিদেশে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সরেজমিন: বন্দরের ৪ নম্বর ফটকে গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, প্রবেশ ও বের হওয়ার আলাদা পথে নিরাপত্তার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।

বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের উপপরিচালক মেজর মো. রেজাউল হক প্রথম আলোকে জানান, ডিজিটাল পাস ছাড়া বন্দরে এখন প্রবেশ বা বের হওয়ার সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত ৭৯ হাজার ২৮১ জনকে ডিজিটাল পাস দেওয়া হয়েছে। সবারই তথ্য আছে বন্দরের ডেটাবেইসে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সুপারিশের পর বন্দরে সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা ১২৮ থেকে বাড়িয়ে ৪৫৯টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে বন্দরের হিসাবে, পুরো এলাকা তদারকির জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ সিসিটিভি ক্যামেরা দরকার। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধিদল আসাকে কেন্দ্র করে বন্দর, ১৮টি ডিপোসহ মোট ৪২টি স্থাপনায় এখন কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।