চট্টগ্রাম পড়ছে ঢাকা উড়ছে

ভোজ্যতেলে চট্টগ্রামের এক সময়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এমইবি গ্রুপ এখন বন্ধ
ভোজ্যতেলে চট্টগ্রামের এক সময়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এমইবি গ্রুপ এখন বন্ধ

ভোজ্যতেলের ব্যবসা নিয়ে সব গল্পই ছিল চট্টগ্রাম ঘিরে। পুরো দেশের ব্যবসায়ীরা কান পেতে থাকতেন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। হবেই-বা না কেন? এখানকার ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল বাজারের ৭৮ শতাংশ হিস্যা। এসব অবশ্য এক দশক আগের কথা। এখন তা ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতিতে। চট্টগ্রামের গল্পে এখন ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ী বলতে পরোয়ানা, কারাগার আর দেশছাড়ার কথাই লেখা হচ্ছে। 

কী ছিল সুদিনে? খাতুনগঞ্জে গেলে এখনো শোনা যায় মুছে যাওয়া সময়ের কথা। ব্যবসায়ী শাহেদ উল আলম তো বলেই ফেললেন, ‘এক সময় ইলিয়াছ ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপ কিংবা নুরজাহান গ্রুপের কার্যালয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা অস্থিরভাবে পায়চারি করতেন। সেসব দিন স্বর্ণযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।’ 

২০০৮ সালের দিকে ঢাকার ব্যবসায়ীদের বাজার হিস্যা ২২ শতাংশে আটকে রেখেছিলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকে উল্টে যেতে থাকে হিসাব। পড়তে পড়তে এখন চট্টগ্রামের হাতে আছে বাজারের ৩৯ শতাংশ। ঢাকার ব্যবসায়ীদের হিস্যা ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬১ শতাংশে। 

ভোজ্যতেলের বাজার থেকে একে একে বিদায় নিয়েছে চট্টগ্রামের এমইবি, মোস্তফা, এসএ, নুরজাহানের মতো সাতটি প্রতিষ্ঠান। এখন এদের কেউ কেউ এখন হঠাৎ হঠাৎ আমদানিকারকের তালিকায় নাম উঠালেও তা পরিমাণ খুবই নগণ্য। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের নামও বদল করতে হয়েছে। না হলে যে ঋণের ভারে নুয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানের আমদানিরই সুযোগ থাকে না। 

চট্টগ্রামে যখন একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ঢাকায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ভোজ্যতেল পরিশোধনের কারখানা গড়ে তুলছে। ২০১৩ সালে খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় আসা বসুন্ধরা গ্রুপ গেল বছর আমদানি শুরু করেছে। দুই বছর আগে যুক্ত হয়েছে গ্লোব এডিবল অয়েল ও সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ। তিন বছর আগে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল মোংলায় সুন সিং গ্রুপের কারখানা কিনে নিয়েছে। আরও বড় হয়েছে ঢাকার সিটি ও মেঘনা গ্রুপ। 

ঢাকা-চট্টগ্রামের উত্থান-পতন ক্রেতাদের জন্যও দুশ্চিন্তার। কারণ এতে আসলে ভোজ্যতেলের বাজারে কমে যাচ্ছে প্রতিযোগীর সংখ্যা। এক দশক আগে ৯ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এখন বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকায় (শুধু পাম তেল ও সয়াবিন)। কিন্তু প্রতিযোগীর সংখ্যা কমছে, ১১ জনের জায়গায় এখন ৬ কোম্পানির হাতে বাজারের ৯৬ শতাংশ। 

ভোজ্যতেলের বাজারে এখন চট্টগ্রামের নাম রাখছে টিকে গ্রুপ ও এস আলম। বাকিদের খাতুনগঞ্জের কার্যালয়ে এক সময় ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা বসে থাকতেন ঋণপত্র খোলার ব্যবসা পেতে। এখন তাদের বিরুদ্ধেই নথিপত্র নিয়ে অর্থঋণ আদালত আর উকিলের কাছে দৌড়াচ্ছেন ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপকেরা। ব্যবসায়ীদের কারও জায়গা হয়েছে কারাগারে। কেউবা আড়াল করেছেন নিজেদের। 

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ছিটকে পড়ার কারণ হিসেবে আগ্রাসী বাণিজ্য বা ব্যাংকঋণের নির্ভরতার কথা বেশি আলোচনায় আসে। ব্যাংকের টাকা শোধ না করে জমি কেনার অভিযোগও আছে তাতে। অবশ্য বাজার থেকে ছিটকে যাওয়া ব্যবসায়ীদের এককথা—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে লোকসানে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে তাদের দুর্দিনের শুরু। দ্বিতীয় কারণ, পরের বছরগুলোতে বিশ্ববাজারে দামের উত্থান–পতন। ঢাকার ব্যবসায়ীরাও ধাক্কা খেয়েছেন। তবে বেশি আগ্রাসী হয়ে ঝুঁকি নেননি। তাঁদের অন্য ব্যবসা দেখে ব্যাংকগুলোও পাশে দাঁড়িয়েছে। তাতেই কিছুটা হলেও রক্ষা। 

সুদিন হারানো চট্টগ্রামের বিপরীতে এখন ঢাকার শুধু উত্থানের গল্প। ভোজ্যতেলের বাজারে উড়ছে ঢাকা।