সুদহার যখন শূন্যের কাছাকাছি

বিশ্বজুড়ে সংঘটিত আর্থিক সংকটের সবচেয়ে তীব্র সময়টা ছিল প্রায় এক দশক আগে ২০০৮ সালের দিকে। সংকট কাটানোর অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে উন্নত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একযোগে তখন নীতিনির্ধারণী সুদের হার কমিয়ে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে ঠেকিয়েছিল। দেখতে দেখতে এক দশক পেরিয়ে গেল, কিন্তু এখনো বিশ্ব অর্থনীতি স্বল্প সুদের হারের পরিবেশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে বিশ্বের প্রধানতম অর্থবাজারে সুদের হারের চিত্রটা ছিল অনেকটাই এ রকম—১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের সুদের হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশের নিচে, যুক্তরাজ্যে সেটা ১ শতাংশের একটু বেশি, জার্মানিতে মাত্র ০.৪ শতাংশের আশপাশে এবং জাপানে সেটা বলা যায় শূন্য শতাংশ। অর্থনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই নিম্ন সুদের হার আসলে কতটা অস্বাভাবিক? অর্থনীতির গবেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক গড় সুদের হার (মূল্যস্ফীতি সমন্বিত) কমার গত এক দশকের যে প্রবণতা, সেটা আসলে অতুলনীয়। এমনকি ১৯৩০-এর দশকে সংঘটিত মহামন্দার সময়কালেও সুদের হারের এই নিম্ন প্রবণতা দেখা যায়নি। 

সুদের হার কমার এই প্রবণতা থামার কোনো লক্ষণ নেই। এই যেমন শুধু ২০১৯ সালের গত ৮ মাসে বিশ্বজুড়ে ৩০ টির বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুদের হার কমিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো। তাদের দুশ্চিন্তা শুধুই ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ও ব্রেক্সিট নিয়ে। 

জুলাইয়ের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ২ থেকে ২.৫ শতাংশের মধ্যে নিয়ে এসেছে এবং একই সঙ্গে সামনে সুদের হার আরও কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বারবার টুইট করে একই তাগিদ দিচ্ছেন। মেক্সিকো গত সপ্তাহে অর্থনীতিবিদদের অবাক করে দিয়ে ঋণের সুদের হার কমিয়েছে, তা-ও ২০১৪ সালের পর এই প্রথম। ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক দিন থেকেই সুদের হার শূন্য শতাংশে রেখেছে। কিন্তু এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, এটা সামনের দিনে ঋণাত্মক বা নেগেটিভে যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়া বিগত ২৮ বছরে মন্দা অর্থনীতি কি এটা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু গত কিছুদিন ধরেই দেশটি বেকারত্ব বাড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, মজুরি হার বাড়ছে না, আবাসন খাতে মন্দা যাচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতিও লক্ষ্যের চেয়ে নিচে। এই যখন অবস্থা, তখন গত জুনে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে ১.২৫ %-এ নির্ধারণ করেছে, যা ইতিহাসে সবচেয়ে কম। অনেকেই বিশ্বাস করছে, সামনের দিনে এটা আরও কমতে পারে। 

 শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের শক্তিকান্ত দাস ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত চারটি নীতিনির্ধারণী মিটিং করেছেন, যার প্রতিটিতেই রেপো হার কমিয়েছেন। সর্বশেষ আগস্টের ৭ তারিখের মিটিংয়ে রেপোর হার কমিয়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কিনা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, বর্তমান অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে সুদের হার আর এক ধাপ কমবে। 

তার মানে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একযোগে এমন এক যুগের অবসান ঘটাচ্ছেন, যখন অনেকেই আশা করেছিল সুদের হার আবার পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। প্রশ্ন হলো, বিশ্বজুড়ে সুদের হার কমানোর এই হিড়িক পড়ল কেন? 

প্রথাগতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যয়কে উৎসাহিত করে অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য সুদের হার কমিয়ে থাকে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই যখন সুদের হার বেশ নিচু অবস্থায় রয়েছে, এখন সুদের হার আরও এক ধাপ কমিয়ে ব্যয়কে আরও উৎসাহিত করার মতো জায়গা আছে কি না, এটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

কিন্তু বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের অনেকেই ২০২০ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে একটা অর্থনৈতিক মন্দার আভাস পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, সেই সম্ভাব্য মন্দার ঝুঁকিকে হ্রাস করার একটা পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আগেভাগেই অর্থনীতিকে একটু দম ফেলার অবস্থা সৃষ্টি করে দিচ্ছে। গল্পটা এখানে থামলেই হয়তো ঠিক ছিল। 

কিন্তু নতুন করে গত বছরের শুরুতে আরম্ভ হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ এই গল্পকে থামাচ্ছে না। বলা যায়, প্রধানতম কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ঠিক এই মুহূর্তে সুদের হার কমিয়ে ঋণকে আরও সস্তা করার মিশনে নেই, বরং বাণিজ্যযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য সুদের হারকে পরিবর্তন করে মুদ্রাকে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে রপ্তানিকে উৎসাহিত করাটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। 

কিন্তু একই সঙ্গে যেহেতু অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সুদের হার কমিয়ে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করছে, এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী চিন্তা আসলে কতটা কাজে দেবে, এটা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। আরেক পক্ষ বলছে, দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে অনেক আশার বাণিজ্যচুক্তির যেহেতু কোনোই সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু বিনিময় হারকেন্দ্রিক মুদ্রানীতিই মনে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একধরনের বাস্তবতা।