দেশেই এখন বিশ্বমানের সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে

আমিরুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রিমিয়ার সিমেন্ট
আমিরুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রিমিয়ার সিমেন্ট
>

সিমেন্ট উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রিমিয়ার সিমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ দেশের সব বড় মেগা প্রকল্পে সিমেন্ট সরবরাহ করছে। সিমেন্ট খাতের বাজার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ।

প্রথম আলো: সিমেন্টের বাজারের অবস্থা এখন কেমন?

আমিরুল হক: ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে সিমেন্টের ব্যবহার হয়। আগে শুধু শহরে অবকাঠামো খাতে সিমেন্টের ব্যবহার ছিল বেশি। দেশে এখন বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। গ্রামগঞ্জে ব্যক্তিশ্রেণি খাতে অবকাঠামোও বাড়ছে। প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ যাচ্ছে আবাসনে। ঢেউটিনের বদলে পাকা ঘর নির্মাণ হচ্ছে। গ্রামে স্কুল, বাণিজ্যিক ভবনসহ নানা ধরনের অবকাঠামো হচ্ছে। বড় প্রকল্পের পাশাপাশি গ্রামে অবকাঠামো গড়ে ওঠায় সিমেন্টের চাহিদা বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এখন গড়ে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী এক দশক এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

প্রথম আলো: গত কয়েক বছরে অনেক কারখানা সম্প্রসারণে গেছে। প্রিমিয়ার সিমেন্টও বড় আকারে সম্প্রসারণে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি করার মতো বাজার তৈরি হয়েছে?

আমিরুল হক: সিমেন্ট কারখানায় বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতার বড়জোর ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সিমেন্ট উৎপাদন করা যায়। এখন সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টনের যে উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে, তা দিয়ে সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি প্রকৃত উৎপাদন সম্ভব নয়। এ কারণে যেসব ব্র্যান্ডের সিমেন্টের চাহিদা বেশি, তারাই বাজার ধরার জন্য কারখানা সম্প্রসারণে যাচ্ছে।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের উৎপাদনক্ষমতা বর্তমানে দৈনিক ৯ হাজার টন। এই উৎপাদন সক্ষমতা দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। উৎপাদনক্ষমতা বেশি না থাকায় অনেক প্রকল্পে আমরা সিমেন্ট দিতে পারিনি। এ কারণেই কারখানা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের কারখানা সম্প্রসারণ করে উৎপাদনক্ষমতা ৯ থেকে ২৫ হাজার টনে উন্নীত করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সম্প্রসারিত কারখানায় উৎপাদন শুরু হবে। তখন বার্ষিক প্রকৃত উৎপাদনক্ষমতা হবে ৬০ লাখ টন।

প্রথম আলো: বাজারে প্রিমিয়ার সিমেন্টের অবস্থান কেমন?

আমিরুল হক: বিক্রির পরিমাণের চেয়ে আমরা সিমেন্টের গুণগত মানকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিই। মানের ক্ষেত্রে কখনোই আপস করি না। গুণগত মানের ধারাবাহিকতাও বজায় রাখছি আমরা। এ কারণে গুণগত মানে প্রিমিয়ার সিমেন্ট এখন শীর্ষে। গুণগত মানের জন্য ‘ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অ্যান্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স’সহ বহু পুরস্কার পেয়েছি আমরা। গুণগত মান বজায় রাখার জন্যই দেশের সব বড় প্রকল্পে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ সব বড় প্রকল্পে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়েছে।

গুণগত মান বজায় রাখতে দুটো বিষয় গুরুত্ব দিই আমরা। প্রথমটি হলো ক্লিংকারসহ সিমেন্টের পাঁচটি কাঁচামালের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা। আমাদের কারখানার কাঁচামাল বিশ্বের যেসব দেশ থেকে সংগ্রহ করি, সেখানে আমাদের মান নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে দেখেন। মান নিশ্চিত হওয়ার পরই জাহাজে পাঠানো হয়।

প্রথম আলো: বড় প্রকল্পে কোন ধরনের সিমেন্ট সরবরাহ করেন আপনারা?

আমিরুল হক: দেশে দুই ধরনের সিমেন্ট রয়েছে। একটি পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট। অন্যটি অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট। তবে মেগা প্রকল্প বা বড় অবকাঠামোতে প্রকল্পের ধরন অনুযায়ী সিমেন্ট সরবরাহ করতে হয়। যেমন: মাটির নিচে নির্মাণকাজের জন্য যে সিমেন্ট ব্যবহার হবে, সেতুর জন্য ব্যবহার হবে অন্য গ্রেডের সিমেন্ট। মেগা প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী সিমেন্ট সরবরাহ করতে হয়। এসব প্রকল্পের দেশি–বিদেশি প্রকৌশলীরা সিমেন্টের মান যাচাই করে নিশ্চিত হন। গুণগত মান ঠিক আছে বলেই মেগা প্রকল্পে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে।

প্রথম আলো: সিমেন্টশিল্পে জোয়ার শুরু হয় ১৫–২০ বছর আগে। এ সময়ে এই শিল্প কতটুকু এগিয়েছে?

আমিরুল হক: বড় উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই সিমেন্টশিল্পে বিপ্লব হয়েছে। একসময় আমদানিনির্ভর ছিল এ শিল্প। এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও হচ্ছে। গত ১৫ বছরে সিমেন্টশিল্পে দুই ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। উৎপাদন দ্রুত বাড়ছে। এখন এই শিল্পে বছরে সোয়া তিন কোটি টন সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। আবার বিশ্বমানের সিমেন্ট তৈরি হচ্ছে দেশে। এর বড় প্রমাণ হলো, মেগা প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শকেরাই কিন্তু সিমেন্টের মান যাচাই করে দেশীয় সিমেন্টই ব্যবহার করছেন।

প্রথম আলো: এ শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন?

আমিরুল হক: মোট উৎপাদনের দিক থেকে আমরা বিশ্বে ২০তম। তবে জনপ্রতি সিমেন্ট ব্যবহারে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এখন দেশে জনপ্রতি বার্ষিক সিমেন্টের ব্যবহার মাত্র ১৮০-১৯০ কেজি। বিশ্বে জনপ্রতি বার্ষিক সিমেন্টের ব্যবহার সাড়ে ৫০০ কেজির বেশি। এর অর্থ হলো, দেশে সিমেন্টের ব্যবহার বাড়ার বা বাজার বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী কয়েক দশক সিমেন্টের ব্যবহার বাড়ার সুযোগ আছে।