অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় অলংকার ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব

দেশের বাজারে গত দুই মাসে ছয় দফায় সোনার ভরি ৫ হাজার ৮৩২ টাকা বেড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভালো মানের সোনার দাম বেড়ে ভরিপ্রতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ২৮ টাকা। এটি ২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ দাম। সে সময় সোনার ভরি ৬০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছিল। অস্বাভাবিক দাম বাড়া কারণে অলংকার ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। 

জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কোরবানির ঈদের পর বিয়ের মৌসুম শুরু হয়। ফলে সোনার অলংকারের ক্রয়াদেশ বাড়ে। তবে গত দুই মাসে সোনার দামে অস্থিরতা থাকায় অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না। তাতে ব্যবসা কমে গেছে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ।

>২০১২ সালের পর সর্বোচ্চ দামে সোনা বিক্রি হচ্ছে
অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না
ভরা মৌসুমে জুয়েলার্স ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব
ব্যবসা কমে গেছে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ

দেশে বৈধভাবে সোনা আমদানি হয় না বললেই চলে। ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে আসা সোনা ও স্থানীয় বুলিয়ন মার্কেটের মাধ্যমে সোনার চাহিদা পূরণ হয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুসরণ করে দীর্ঘদিন ধরে সোনার দাম নির্ধারণ করছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। অবশ্য সরাসরি আমদানি হলে সোনার ভরি বর্তমান দরের চেয়ে অন্তত ৬ হাজার টাকা কম হতো। তাতে ৫৮ হাজার টাকার ভরি হয়ে যেত ৫২ হাজার টাকা। 

জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক ভরির অলংকার বানাতে সোনার দামের সঙ্গে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা মজুরি ও ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট যুক্ত হয়। তবে বিক্রি করতে গেলে সোনার অলংকারের ওজনের ৮০ শতাংশ দাম পান ক্রেতা। কারণ, অলংকার বানানোর সময়ই মজুরি ও অপচয় বাবদ ২ আনা সোনা (এক ভরিতে ১৬ আনা) নেন কারিগর। তবে অলংকারের মজুরি বাবদ যে টাকা নেওয়া হয়, সেটি যায় ব্যবসায়ীদের কাছে। সব মিলিয়ে তাঁদের মুনাফা ১০ শতাংশের মতো। 

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে দেশের সোনার বাজারও অস্থির। তাহলে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কেন বাড়ছে? কারণ হচ্ছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিভিন্ন দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। শেয়ারবাজার অস্থির হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ডলার দুর্বল হচ্ছে। এতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ডলারের বদলে সোনা বেছে নিয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও সোনা কিনে রাখছেন। এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম কয়েক মাস ধরে বাড়ছে। গতকাল প্রতি আউন্স ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল ১ হাজার ৫৩০ ডলার। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৬০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

দেশে সোনার অলংকারের বড় বাজার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেট। সেখানে ১১০টি জুয়েলার্স আছে। গতকাল দুপুরে পুরো মার্কেট ঘুরে দেখা গেল, হাতে গোনা তিন-চারটি ছাড়া অধিকাংশ দোকানেই কোনো ক্রেতা নেই। বিক্রয়কর্মীরা অলস সময় পার করছেন। 

জানতে চাইলে লিলি জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী বাবলু দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে অর্ধেকে নেমেছে। ক্রেতারা প্রতিদিনই সোনার দাম জানতে ফোন করছেন। তবে সে অনুযায়ী ক্রয়াদেশ আসছে না।’ তিনি বলেন, সোনার দামের অস্থিরতার কারণে এক মাস পর ডেলিভারি নিতে হলে সেই সময়ের বর্ধিত দাম দিতে হচ্ছে। তবে কেউ যদি ক্রয়াদেশের সঙ্গে ৮০ শতাংশ মূল্য পরিশোধ করে তাহলে ভিন্ন কথা। 

অন্যদিকে গ্রামীণ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী দিলীপ রায় বললেন, সোনার দাম নিয়ে ক্রেতারা আতঙ্কিত। অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না। যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা আবার পূর্বপরিকল্পনায় কাটছাঁট করছেন। সব মিলিয়ে অন্য বছরের চেয়ে ক্রয়াদেশ ৫০ শতাংশ কমেছে। তিনি আরও বলেন, স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী সোনা আমদানির জন্য ডিলার নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি শিগগিরই হয়ে গেলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১১ মার্চ সোনা আমদানির পরিবেশক (ডিলার) নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আগ্রহী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক আবেদন করতে পারবে। গত সপ্তাহে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড সোনা আমদানির পরিবেশক লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছে। তার বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সরাসরি সোনা আমদানি হলে দাম কতটা কমবে সে বিষয়ে ধারণা পেতে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি জানান, গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ১ হাজার ৫৩০ মার্কিন ডলার। তাতে দেশীয় মুদ্রায় দাম আসে ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০ টাকা। এক আউন্সে ৩১ দশমিক ১০৩৪৭৬৮ গ্রাম। আর ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে এক ভরি। তাতে প্রতি ভরির দাম আসবে ৪৮ হাজার ৭৭০ টাকা। তার সঙ্গে ২ হাজার টাকা শুল্ক যুক্ত হবে। তারপর ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলেও প্রতি ভরির দাম ৫২ হাজার টাকার মধ্যে থাকবে। অথচ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ হাজার টাকার বেশি।