বড় প্রকল্পে ধীরগতি, আশা শুধু পদ্মায়

দেশে বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু ও ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল ছাড়া অন্য কোনোটিতে তেমন একটা অগ্রগতি নেই। সরকার এ রকম ১০টি ফাস্ট ট্র্যাক বা অগ্রাধিকারমূলক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এ ক্ষেত্রে গত জুলাই মাস পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ ৭২ শতাংশ শেষ হয়েছে। এলএনজি টার্মিনালের কাজও ইতিমধ্যে শেষ। দুটি প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। বাকি ছয়টির কাজে অগ্রগতি ১৫ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। কাজের গতি বিবেচনা করলে এসব প্রকল্প আগামী দু-এক বছরের শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এদিকে কাজের দিক থেকে এগিয়ে থাকা পদ্মা সেতুর মেয়াদ ও খরচ বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজে নিবিড় তদারকি প্রয়োজন। যথাসময়ে প্রকল্পগুলো শেষ না হলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বর্তমান সরকার ১০ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে ১০টি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। এই তালিকায় আছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, রাজধানীতে মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ।

১০টি প্রকল্পের মধ্যে গত বছর বিল্ড ওন অপারেট (বিওটি) পদ্ধতিতে মাত্র মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু হয়েছে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শুরু হয়নি। দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের মূল কাজও শুরু হয়নি। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। 

সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ হলো—প্রকল্প কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব; বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ওই সব প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া; দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ করে মূল কাজ শুরু করতে বিলম্ব; হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির কারণে নানা ধরনের কারিগরি সমস্যায় মাঝপথে কাজের শ্লথগতি ইত্যাদি। ঠিক সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়ে ঠিকাদারদেরও অনীহা আছে। এ জন্য ঠিকাদারদের জবাবদিহিতে আনা যায় না। 

এই বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিবিড় তদারকির অভাবে প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না। ফলে খরচ ও সময়—দুই–ই বাড়ছে। খরচ ও সময় বৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। যেমন এসব প্রকল্প শেষ না হওয়ায় বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাচ্ছে না। আবার সময় ও খরচ বেশি লাগলে প্রকল্পের সুবিধা ব্যয়বহুল হয়ে যায়। তাঁর মতে, ঠিকাদারদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। যেসব কারণে প্রকল্প বিলম্বিত হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। সমস্যা নিরসনের উদ্যোগগুলো তদারকিতে রাখার তাগিদ দেন তিনি।

পদ্মা সেতুতে বেশি অগ্রগতি

চালু হওয়া এলএনজি টার্মিনাল ছাড়া পদ্মা সেতুর কাজ সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে। গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ৭২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটির ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। দুই পারের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ। মূল সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে আগামী ডিসেম্বর মাসে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটির জন্য মাত্র ৫ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের খরচ এবং মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগও শুরু হয়েছে।

২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে রেল সংযোগ ছিল না, পরে তা সংযোজন করা হয়। নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে দু-তিন বছর সময় চলে যায়। এরপর দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। পরে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এসব জটিলতা কাটিয়ে মূল সেতু নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। 

দৃশ্যমান হচ্ছে মেট্রোরেল

ঢাকায় যানজট কমাতে এবং যাত্রীদের দ্রুত চলাচলের জন্য ২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর, ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৩০ শতাংশ বা মাত্র ৭ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯ সালের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করার কথা থাকলেও পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছে সরকার। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পুরো পথটি একসঙ্গে চালু করতে চায় সরকার।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পিলার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ, এখন স্প্যান বসছে। অন্যদিকে আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও শাহবাগ অঞ্চলের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগে প্রথম পাঁচ বছর চলে গেছে।

 বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্রগতি কম

ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকায় তিনটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। সেগুলোর অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। এই প্রকল্পের ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে শেষ করার কথা প্রকল্পটি। পরিবেশের ঝুঁকি নিয়ে শুরু হওয়া রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে অগ্রগতি মাত্র ৩৫ শতাংশ। খরচ হয়েছে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি মাত্র ২৫ শতাংশ। 

এদিকে সাত বছরের পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে প্রথম তিন বছরে বাস্তবায়ন মাত্র ৩০ শতাংশ। আর পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজে ৬০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।