এশিয়ার কালো মেঘে কিছুটা উজ্জ্বল বাংলাদেশ

বাণিজ্যযুদ্ধের ঢেউ সব জায়গাতেই আছড়ে পড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যে বিদ্যমান শুল্কের হার বাড়িয়ে দেওয়ার পর এশিয়ার অর্থনীতিতে রীতিমতো কাঁপন ধরেছে। এই ধাক্কায় গতকাল বৃহস্পতিবার হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের সাংহাই কম্পোজিট সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, জাপানের নিক্কি সূচক শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোপসি সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। শুধু শেয়ারবাজারই নয়, এশিয়ার রপ্তানিও কমে গেছে। বিবিসি ও সিএনএন সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখনো অতটা আক্রান্ত হয়নি, যদিও শেয়ারবাজার কয়েক মাস ধরেই টালমাটাল। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ বেশি দামি বা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন পণ্য রপ্তানি করে না বলে এখনো অতটা আক্রান্ত হয়নি। তবে বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের রপ্তানিও কমতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানোর আগে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। এই উভয় শুল্ক আগামী রোববার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জি–৭ শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে আবার বৈঠক শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মানচিনও চীনের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলেছেন। যথারীতি তিনিও বলেননি যে এই বৈঠক কবে থেকে শুরু হতে পারে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

>বাংলাদেশ পোশাকের মতো মৌলিক পণ্য রপ্তানি করে এখনো আক্রান্ত হয়নি
বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা

শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় চীন নিজস্ব ভঙ্গিতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে, যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে মুদ্রা কারসাজিকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন আগেই আরও এক দফা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে ইউয়ানের বিনিময় হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এক ডলারের বিপরীতে ৭ দশমিক ১৬ ইউয়ান পাওয়া গেছে। আর অফশোর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৭ দশমিক ১৭ ইউয়ান। চলতি মাসে চীনের বাইরে ইউয়ানের অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

অন্যদিকে জুন মাসে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রপ্তানি অনেকটা পড়ে গেছে। বিশেষ করে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা খুবই টালমাটাল। অনেকে বলছেন, স্বাধীনতার পর ভারতের অর্থনীতির এই অবস্থা হয়নি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার বড় বড় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও সেসব দেশে যে এখনই মন্দা হবে, তা নয়। তবে হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো ছোট দেশগুলো নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকির মুখে আছে।

অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এশিয়া অর্থনীতি বিভাগের প্রধান লুইস কুজিস বিবিসিকে বলেছেন, দুই রাজার যুদ্ধে উলুখাগড়ার যে অবস্থা হয়, এই দেশগুলোর অবস্থা অনেকটা সে রকম। তাঁর ভাষায়, মার্কিন–চীন বাণিজ্যযুদ্ধে এরা ‘নিরীহ দর্শকের’ মতো। ব্যাপারটা হলো, হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো ছোট দেশগুলো মূলত বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতি। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে এদের বাণিজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ওপর এশিয়ার অনেক দেশই নির্ভরশীল। মূলত চীনের উৎপাদনের সঙ্গে এসব দেশে নানাভাবে যুক্ত। চীন যে কার্যাদেশ পায়, তার সব তো আর নিজেরা উৎপাদন করে না, ছোটখাটো বা শ্রমঘন কাজগুলো তারা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের মতো দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে চীনের কার্যাদেশ পাওয়া কমে গেলে এই দেশগুলো বিপাকে পড়বে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতসহ অনেক দেশই সুদের হার কমিয়ে চাহিদা চাঙা করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে ভারত গত এক বছরে চারবার রেপো রেট কমিয়েছে। সুদের হার কমানোর প্রসঙ্গে ব্যাংক অব জাপানের পর্ষদ সদস্য হিতোশি সুজুকি বৃহস্পতিবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, সুদের হার বেশি কমানো খারাপ হতে পারে। তিনি মনে করেন, সুদের হার কমানো হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অর্থনীতিতে আঘাত লাগে। জাপানের সুদের হার এমনিতেই অনেক কম। তারপরও বিনিয়োগকারীরা জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে আছেন, সুদের হার আরও কমে কি না।

ভারতের গাড়িশিল্পের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যেখানে ভারতে ২ লাখ ৯১ হাজার গাড়ি বিক্রি হয়েছিল, সেখানে চলতি বছরের জুলাই মাসে তা নেমে এসেছে ২ লাখ ১ হাজারে। এই পরিস্থিতিতে মারুতি–সুজুকি এ সপ্তাহে তিন হাজার অস্থায়ী কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে উৎপাদনশীল খাত হিসেবে এতে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এই খাত সংকুচিত হলে মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।