খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যবসার খরচও বেড়ে যায়

আনিস এ খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক
আনিস এ খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক
চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন এ ছয় মাসেই দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি, সুদহার ও ব্যাংক খাত নিয়ে কথা বলেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। অর্থমন্ত্রীও আপনাদের নিয়ে আলোচনা করলেন। কিছুদিন আগেও তারল্যসংকট ছিল, এখন কী সমস্যা? 

আনিস এ খান: ব্যাংক খাতে কিছুদিন আগেও তারল্যসংকট ছিল। এখন বেশির ভাগ ব্যাংকই সে সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমাদের মতো ব্যাংকও ঋণ আমানত অনুপাতের সীমা অতিক্রম করেছিল। এখন এ সীমার অনেক নিচে চলে এসেছে। অনেক গ্রাহক এখন ব্যাংকে নতুন করে টাকা জমা করছে। আমাদের ব্যাংকে প্রতিদিনই এক হাজার হিসাব খোলা হচ্ছে। তাই ব্যাংকগুলোর এখন তারল্য নিয়ে চিন্তা নেই। বড় চিন্তা খেলাপি ঋণ নিয়ে। খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। 

প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ তো বাড়ছেই। এত ছাড়, নতুন সুবিধা—এরপরও কমানো যাচ্ছে না কেন? এতে কি সমস্যা হচ্ছে? 

আনিস এ খান: ১০ বছর আগে যখন আমি এমটিবিতে যোগদান করি, তখনই খেলাপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম। এর ফলে খেলাপি ঋণ অনেক কমাতে পেরেছিলাম। আমি বলেছিলাম, নতুন ও ভালো গ্রাহকদের সঙ্গে আমার দেখা করার প্রয়োজন নেই। খেলাপিদের সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। তাদের সমস্যা দেখেছি। অনেকে সমস্যায় পড়ে খেলাপি হয়েছে, আবার অনেকে ইচ্ছাকৃত খেলাপিও আছে। খেলাপি ঋণ একটা বড় সমস্যা। কারণ, আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতো যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান আছে, তারা এটা খুব ভালো করে দেখে। আবার বৈদেশিক ব্যবসার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যে সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন, আমাদের সঙ্গে তা হয় না। ফলে ব্যাংকের বিদেশি ব্যবসায় সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসির মতো বড় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমাদের ব্যবসা চালাতে হয়। আবার খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যবসার খরচও বেড়ে যায়। 

প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ বাড়লে আমদানি-রপ্তানিতে খরচ বাড়ে। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খেলাপি ঋণ কমাতে কি যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? 

আনিস এ খান: ১০ বছর আগে ঋণখেলাপিদের জন্য যতটা উদ্যোগ প্রয়োজন হতো, এখন তা বহু গুণ বেড়ে গেছে। এ জন্য আইনি পদক্ষেপগুলো জোরালো করা দরকার। আর নতুন করে ঋণ দেওয়ার সময় অনেক পর্যালোচনা করতে হবে। শুধু ব্যাংকের নয়, গ্রাহকদেরও দায়িত্ব আছে। তারা ঋণ নিয়ে যথাযথ ব্যবহার না করলেই সমস্যা তৈরি হয়। আমার অভিজ্ঞতা বলে, যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁদের ঋণের চাহিদা কম। আবার ঋণ নিলে আগেভাগেই ফেরত দিয়ে দেন। ব্যাংক কোম্পানি, অর্থঋণ আদালত আইন পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে খেলাপি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে। এতে দুষ্ট ব্যবসায়ীরা কিছুটা চাপে থাকবে। আমরা আইনের সহায়তা চাই। এটাই এখন খেলাপির টাকা আদায়ের অন্যতম মাধ্যম। খেলাপি ঋণ আদায়ে সব ব্যাংকই যথাযথ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে নিয়মিত হওয়া অনেক ব্যবসায়ী আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। 

প্রথম আলো: দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। সে তুলনায় দেশের ব্যাংকগুলোর ভিত্তি কি শক্তিশালী হচ্ছে? 

আনিস এ খান: দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ৬০টি ব্যাংক অনেক বেশি। বেশি ব্যাংক হয়ে গেছে। এ কারণে ঋণের মানও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একটা বিষয়ে কেউ নজর দিচ্ছে না। সেটা হলো ব্যাংকগুলোকে এখন মূলধন বাড়াতে হবে। ব্যাসেল-৩ নীতিমালা আছে, ব্যাংকগুলো তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি আগের অর্থমন্ত্রীকে বারবার বলেছি, দেশের ব্যাংকগুলো একীভূত ও অধিগ্রহণ করতে হবে। তাহলে ব্যাংকগুলোর ভিত শক্তিশালী হবে। দেখেন গ্রিন্ডলেজকে কিনে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড এখন কত বড়। আর ব্যাংক এশিয়া বিদেশি তিন ব্যাংকের দায় সম্পদ নিয়ে এখন বড় হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে যখন মূল্যায়ন করা হয়, তখন হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংক আসে। কারণ, অন্য ব্যাংকগুলোর সম্পদ খুবই কম। তাই পাঁচ-ছয়টি ব্যাংক মিলে একীভূত হলে বড় ব্যাংক হয়ে যাবে। এভাবে দেশের ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করা সম্ভব। প্রথম আলো: সরকার সুদহার এক অঙ্কে নিয়ে আসতে চায়। তাহলে আমানতের সুদহারও তো কমবে। 

আনিস এ খান: সুদহার এক অঙ্কে নেমে আসবে, এটা সরকারের সদিচ্ছা। সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করবে সুদহার কত হবে। দেশের মূল্যস্ফীতি, জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করবে। তবে বাস্তবতা হলো, গ্রাহকেরা কেউ ৬ শতাংশে টাকা রাখতে চাইছেন না। কারণ অনেক ব্যাংক ৯-১০ শতাংশে টাকা নিচ্ছে। তাঁরা অন্য ব্যাংকে চলে যেতে চাইছেন। এ কারণে আমাদেরও অনেক সময় আমানতের সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। তবে যারা বেশি সুদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য টাকা নিচ্ছে, তারা সমস্যায় পড়ে যাবে। এ কারণে সব ব্যাংকের সুদহার কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন। 

প্রথম আলো: এককথায় বলবেন কি, ব্যাংক খাত ঠিক করতে আসলে কী করা প্রয়োজন? 

আনিস এ খান: সবক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। করপোরেট গভর্নেন্সের যে মূলনীতি আছে, তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পুরোপুরি ব্যবস্থাপকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ব্যবস্থাপনার হাতে পুরোপুরি ক্ষমতা দেওয়া উচিত। তাদের জবাবদিহিও যথাযথ হওয়া উচিত। তাহলেই ব্যাংক খাত ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা লাগবে।