বিনিয়োগ-দানে কর রেয়াত

দান করলে কর কমে, আবার বিনিয়োগ করলেও কর কমে। এটা অনেকের কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। কারণ বর্তমানে দেশে কিছু খাতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। আবার কিছু খাতে দান করলে কর অব্যাহতি পাওয়া যায়।

বর্তমানে দেশে ২২টি খাতে বিনিয়োগ ও দান করলে কর রেয়াত মেলে। এর মধ্যে ৯টি বিনিয়োগ খাত ও ১৩টি দান খাত। এসব খাতে কর রেয়াত পেতে একজন করদাতা তাঁর মোট বার্ষিক আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা দান করতে পারবেন। এর বেশি বিনিয়োগ বা দান করলে কিন্তু অতিরিক্ত অংশের জন্য কর রেয়াত মিলবে না। ওই বিনিয়োগকারী বা দানশীল করদাতার বার্ষিক আয় ১৫ লাখ টাকার কম হলে মোট বিনিয়োগ ও দানের বিপরীতে ১৫ শতাংশ কর ছাড় মিলবে। আর বার্ষিক আয় ১৫ লাখ টাকার বেশি হলে ১০ শতাংশ হারে কর ছাড় পাওয়া যাবে।

মনে রাখবেন, সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ বা দান করে কর রেয়াতের সুযোগ নেওয়া যাবে।

এবার আসি, কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যাবে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়, এটা মোটামুটি সচেতন করদাতাদের সবাই জানেন। সঞ্চয়পত্র ছাড়া আরও আটটি খাতে বিনিয়োগ করলে আপনি কর ছাড় পাবেন। খাতগুলো হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার, স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চার ক্রয়; জীবনবিমার প্রিমিয়াম; সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্য তহবিলের চাঁদা; স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাঁদা; কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠীবিমার তহবিলে চাঁদা; সরকার অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ এবং সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ডে চাঁদা।
এ ছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট পেনশন স্কিমে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা রাখলেও কর রেয়াত পাবেন। অর্থাৎ মাসে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিপিএস রাখলে বিনিয়োগজনিত কর ছাড় মিলবে।

অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করেন। দান করলেও কর ছাড় পাওয়া যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, সব জায়গায় দান করলেই কিন্তু এই ছাড় মিলবে না। কর ছাড় পাওয়ার জন্য সরকার কিছু খাত, প্রতিষ্ঠান ও তহবিল ঠিক করে দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান; জাকাত তহবিল; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুমোদিত দাতব্য হাসপাতাল; প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান; মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক; আহসানিয়া ক্যানসার হাসপাতাল; ঢাকা আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল; এশিয়াটিক সোসাইটি; আইসিডিডিআরবি; সিআরপি; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান এবং সরকার অনুমোদিত জনকল্যাণমূলক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, করদাতা বিনিয়োগ করলে রাষ্ট্রের সুবিধা। ব্যক্তির অল্প বিনিয়োগের টাকা বড় বিনিয়োগের অর্থের জোগান দেয়। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এমনিতেই প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এ ধরনের সুবিধা না দিলে বৈষম্য তৈরি হয়। ব্যক্তি করদাতাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতেই কর ছাড় দেওয়া হয়। তাঁর মতে, সামর্থ্যবান করদাতাদের অনেকেই বিভিন্ন খাতে দান করেন, কিন্তু কোথায় দান করলে কর রেয়াত পাওয়া যাবে, তা জানেন না। এ ছাড়া দানের টাকার হিসাবও রাখেন না অনেক করদাতা।

যেভাবে কর রেয়াত মিলবে
বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার সময় যথাযথভাবে হিসাব-নিকাশ করে এ সুযোগ নেওয়া যাবে। বিনিয়োগ বা দানের জন্য কর রেয়াত নিতে হলে আয়কর রিটার্ন ফরমে আলাদা তফসিল আছে। এটি ২৪ডি তফসিল নামে পরিচিত। সেখানে বিনিয়োগ বা দানের বিষয়গুলো উল্লেখ করতে হবে। ওই ফরমটি পূরণ করে বার্ষিক রিটার্নে সংযুক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগ বা দানের প্রমাণপত্রও দিতে হবে।

এবার আসি, আপনি কীভাবে হিসাবটি করবেন। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, আপনি এক কর বর্ষে অর্থাৎ জুলাই থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৮ লাখ টাকা আয় করেছেন। কিন্তু আপনি ওই সময়ে ১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। আর ১ লাখ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডে চাঁদা দিয়েছেন। মোট আয়ের ২৫ শতাংশ হিসেবে সব মিলিয়ে আপনার কর রেয়াত পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে ২ লাখ টাকা। এবার দেখা যাক, রেয়াত পাওয়ার আগে আপনার কত কর হবে। প্রথম আড়াই লাখ টাকা আয়ের জন্য কোনো কর দিতে হবে না। পরবর্তী ৪ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে ৪০ হাজার টাকা কর হলো। বাকি দেড় লাখ টাকার জন্য আপনার কর ১৫ শতাংশ হারে ২২ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ওই বছরে আপনার কর হলো ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।

এবার কর রেয়াত নেওয়ার পালা। যেহেতু আপনি আপনার আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা দান করে কর রেয়াত পাবেন। তাই ৮ লাখ টাকার ২৫ শতাংশ হলো ২ লাখ টাকা। এর মানে, আপনার ওই বছরে বিনিয়োগ করা পুরো টাকাই কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য। যেহেতু আপনার আয় ১৫ লাখ টাকার কম। তাই ওই ২ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩০ হাজার টাকা কর রেয়াত পাবেন। তাই কর রেয়াত পাওয়ার হিসাবের পর বার্ষিক রিটার্নের সঙ্গে আপনার কর দিতে হবে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা।