ভারতীয় রুপির মান কমার লাভ-ক্ষতি

অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো রয়েছে বরাবরই এমনটা দাবি করে আসছে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার। তবে পরিসংখ্যান খুব একটা আশার কথা শোনাচ্ছে না। এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে, শেয়ারবাজারেও চলছে দরপতনের খেলা, আগস্টে কমেছে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি। দফায় দফায় গাড়ি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন শিল্পকে চাঙার পদক্ষেপ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন অবস্থা বেগতিক। এর মধ্যেই যুক্ত হয়েছে মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা।

ভারতীয় রুপির দরপতন হচ্ছে। গত ৩ আগস্ট এক মার্কিন ডলারের (ইউএসডি) বিপরীতে ভারতীয় রুপির দর নিচে নেমে সবচেয়ে বেশি, ৭২ দশমিক ৪১ রুপিতে গিয়ে ঠেকে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে সর্বোচ্চ দরপতন ঘটলে ১ ডলার সমান ৭৪ দশমিক ৪৮ রুপি হয়েছিল। অবশ্য পরে ৪ সেপ্টেম্বর ডলারের বিপরীতে রুপির দর ২৭ পয়সা বাড়লেও আবারও কমার আশঙ্কা রয়েই গেছে।

রুপির মান কমে যাওয়ার স্পষ্টতই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। রুপির দুর্বলতার কারণে ভারতের বাজারে স্বর্ণ ও রুপার দামও বাড়ছে। আমদানি বাণিজ্যেও বিরাট ধাক্কা খাচ্ছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তবে স্থানীয় রপ্তানিকারকেরা লাভবান হচ্ছেন। আসলে চলতি বছরের আগস্ট থেকেই ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু হয়। গত দুই মাসে রুপির মান কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ।

ভারতীয় মুদ্রার দরপতনের প্রভাব আছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। এমনকি বাংলাদেশেও। কেননা টাকার বিপরীতে রুপির দরও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশের এক টাকা ১৭ পয়সায় পাওয়া যায় ভারতের এক রুপি। আর গত বৃহস্পতিবার তা ছিল ১ দশমিক ২৫ টাকা। টাকার বিপরীতে রুপির মান কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বেড়াতে বা চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা কিছু সুবিধা পাচ্ছেন। 

তবে এ ধরনের সুবিধা পেলেও বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারতের চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশেরই। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ভারতীয় রুপির বিপরীতে বাংলাদেশের টাকা শক্তিশালী হওয়ায় রপ্তানি বাণিজ্যে দেশটির সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। যদিও ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মিলছে বাড়তি সুবিধা। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতীয় পণ্যের আমদানি বাড়লে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়বে। এমনিতেই ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির তুলনায় সেখান থেকে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয় ১২৪ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আমদানি ব্যয়ের চূড়ান্ত তথ্য এখনো তৈরি হয়নি। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৬১৪ কোটি ৬২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ এখন দুই দিক থেকেই চাপে আছে। এক চীনের মুদ্রা ইউয়ানের দর কমছে, অন্যদিকে ভারতীয় মুদ্রা রুপির। আসলে দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কারণ, সবাই ইউয়ানকে লক্ষ করছে। সবাই একটি আপেক্ষিক অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে। এমন অবস্থায় ভারত ও চীন থেকে আমাদের আমদানি বাড়বে। এমনিতেই আমাদের সিংহভাগ আমদানি হয় এই দুই দেশ থেকে। ফলে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা বাড়বে। এ ছাড়া ইউরোপ ও অন্যান্য জায়গাতেও আমাদের রপ্তানির অবস্থান খারাপ হবে। কারণ, ওদের মুদ্রারও অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। অথচ ওদের পণ্যের দাম বাড়ছে না। 

এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মুদ্রার অবমূল্যায়ন করাই সংগত বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘যুক্তি দেখানো হয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন মানে টাকার দাম কমলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, বেশির ভাগ পণ্যের দামই বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী। ফলে আমাদের ওপর দামের প্রভাব পড়বে না। তবে আমাদের দেশে পণ্যের দাম কী হচ্ছে, সেটার ওপর নজরদারি করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো যেহেতু আমাদের আমদানি সবচেয়ে বেশি হয় ভারত ও চীন থেকে—দুই জায়গাতেই মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আমরা এখন কমিয়ে দিলে আগের দামটাই পাব। তাই মূল্যস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। আসলে অন্যান্য দেশে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য মুদ্রাকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়। আমাদেরও সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।’

তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক, মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে ভারতের রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পাবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা আলোচনা বা নেগোসিয়েশন করতে পারেন। প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারেন। ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের মিল রয়েছে। তাই আমদানি বেশি হলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে ভারত থেকে আমরা মিডিয়াম পণ্য হিসেবে শিল্পের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিকস পণ্য, তুলা—এসব আমদানি করি। এগুলো কিছুটা কম দামে আসার সুযোগ হবে। অর্থাৎ, শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হবে। তবে কৃষিপণ্য, যেমন: চাল, আদা, ডাল, পেঁয়াজ আমদানি বেশি হলে সরবরাহ বেড়ে যাবে। দেশীয় পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় বলা যায়, বন্যার কারণে এবার আমাদের এসব পণ্যের সরবরাহ কিছুটা কম রয়েছে। তেমনি ভারতেও বন্যার কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ কিছুটা কম রয়েছে। তাই যতটা বেশি আমদানি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ততটা নাও হতে পারে।’

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ভারতের এই মুদ্রার অবমূল্যায়ন দীর্ঘকাল স্থায়ী নাও হতে পারে। ওদের দেশে ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করা হয়েছে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি আসে। অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এর প্রভাব বিনিময় হারের ওপরও পড়বে।’