স্বপ্ন বুননের গল্প

কারুপণ্যে সফিকুল আলম। ছবি: মইনুল ইসলাম
কারুপণ্যে সফিকুল আলম। ছবি: মইনুল ইসলাম

গমগাছের খড় দিয়ে দেড় হাজার ছবি বানিয়ে ১৯৮৬ সালে ঢাকার শিল্পমেলায় একটি স্টল দিয়েছিলেন। মনে করছিলেন অনেক বিক্রি হবে, কিন্তু কোনো ছবি বিক্রি হলো না। ছবিগুলো ছিল দেশ–বিদেশের বরেণ্য গুণী ব্যক্তিসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। ছবি বিক্রি না হওয়ায় হতাশই হলেন। 

এরপর তিনি স্টলে টাঙিয়ে দিলেন ‘আপনি কি আপনার ছবি গমের শিষ দিয়ে বানাতে চান?’ এরপরই অর্ডার আসতে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ১০টি করে ছবি বানাতে থাকেন। বিক্রিও বেশ হয়। এতে উৎসাহিত হয়ে ফিরে আসেন রংপুরে। ভাবতে থাকেন, হস্তশিল্পের কাজ করবেন। ১৯৮৭ সালে ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে রংপুর কারাগারে যান। কারাগারে তাঁতচালী ছিল, সেখানে কয়েদিরা হস্তশিল্পে বুননের কাজ করেন। সেই কাজ তিনি তিন মাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে সেই বুননের কাজে ঝুঁকে পড়েন। গল্পে গল্পে এসব কথা জানালেন সফিকুল আলম সেলিম। 

১৯৯১ সালে ‘কারুপণ্য’ নামে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি বুননের ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে সফিকুল সেলিমের যাত্রা শুরু হয়। এরপর প্রায় ২৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কারুপণ্য এখন রংপুরের ‘হারিয়ে যাওয়া’ শতরঞ্জি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ৩৬টি দেশে রপ্তানি করে। গেল বছর রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। 

স্কুলে অকৃতকার্য হওয়ায় ঘর থেকে বিতাড়ন, আবার বিদ্যালয়ে সেরা ছাত্র হয়ে বিনা খরচে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি, ছাত্ররাজনীতি, জেলখাটা ইত্যাদি নানা কিছু মিলিয়ে সফিকুল সেলিমের বর্ণময় জীবন। 

সফিকুল সেলিম বললেন, তাঁর বাবা মরহুম এম এ সোবহান ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। বাবার কারণে তিনিও ছোটবেলা থেকে জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে। ১৯৮০ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজে অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে না পারায় তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর নিজের চেষ্টায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়ে বিনা টাকায় স্কুলের নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু স্কুল ফাঁকি দেওয়ার কারণে সেখানেও আর পড়তে পারলেন না। এরপর অন্য একটি স্কুল থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি ও ১৯৯১ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স পাস করেন। 

১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে জেলে যাওয়ার গল্প আগেই বলা হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে পরিকল্পনা করেন হস্তশিল্প কারখানা গড়ে তোলার। রংপুর প্রেসক্লাবে (সাবেক) বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) বন্ধ থাকা হস্তশিল্পের একটি দোকান ভাড়া নিয়ে শতরঞ্জির বিপণনকেন্দ্র চালু করেন। হারিয়ে যাওয়া শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা ২০ জন কারিগরকে তিনি খুঁজে বের করেন। সেই পুরোনো কারিগরদের দিয়ে নতুনদের প্রশিক্ষিত করিয়ে শতরঞ্জি বুননের কাজ শুরু হয়। 

১৯৯১ সালে গড়ে তোলেন কারুপণ্য নামের দোকানটি। লোকজনের অর্ডার পেয়ে কারিগরদের দিয়ে শতরঞ্জি সরবরাহ করতে থাকেন। এতে সামান্য আয় হয়। ভাবলেন, এখানেই থেমে থাকলে হবে না। শতরঞ্জি বিক্রির জন্য ব্যাপক প্রচারণায় নামলেন। সাড়াও পেলেন। শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল দেন। একপর্যায়ে শতরঞ্জির চাহিদা বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় ‘শতরঞ্জি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান দেন। 

এখানেই শেষ নয়। শতরঞ্জির বাজার তৈরি করতে বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন বিদেশি ক্রেতাদের কাছে। ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রপ্তানির সুযোগ পান। শুধু জাপান নয়। এই পণ্য পৃথিবীর আরও অনেক দেশে রপ্তানি হতে পারে। ভাবলেন, হস্তশিল্প ‘শতরঞ্জি’ তৈরির কারখানা গড়ে তুলবেন। রংপুর শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পশ্চিমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা ছোট্ট কারখানা ভাড়া নেন। সেখানে ওই গ্রামের ৫০ জন নারী-পুরুষকে নিয়ে কারখানাটি চালু করেন। শুরু করেন বুনন শতরঞ্জি। 

ব্যবসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ‘কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন। গড়ে তুললেন একে একে পাঁচটি কারখানা। এগুলো হলো রংপুরের লাহিড়ীর হাট, পদাগঞ্জ, পীরগাছা, রবার্টসনগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের উলিপুরে। বর্তমানে এসব কারখানায় ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। 

রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জে শতরঞ্জির একটি সবুজ কারখানা রয়েছে। এ কারখানা যেন সবুজের সমারোহ। সবুজ বাগান। নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে ইটপাথরের দালান। ঝুলছে লতাপাতা। সব মিলিয়ে নান্দনিক পরিবেশ। কারখানার বুক চিরে যেন সবুজ হৃদয়। ভবনের ছাদেও সবুজের বাগান। নাম দেওয়া হয়েছে ‘নন্দিনী পার্ক’। ছাদের মধ্যে গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য ছোট ছোট বেঞ্চ। বেঞ্চগুলোতেও শিল্পীর রং–তুলিতে কারুকার্যময় নান্দনিকতার ছোঁয়া আছে। আছে পানির ফোয়ারা, সেখানে আছে পদ্মফুল। দুপুরের খাবার বিরতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে শ্রমিকদের আহার করতে দেখা যায় সেখানে। 

পরিবেশবান্ধব কারখানা ভবন থেকে বের হচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা
পরিবেশবান্ধব কারখানা ভবন থেকে বের হচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা

শতরঞ্জিশিল্পে নারীর প্রতীক হয়ে কারখানার সামনে সবুজ বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৩০ ফুট উঁচু একটি ভাস্কর্য। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বনলতা’। এটি একটি উন্মুক্ত মঞ্চও। এই মঞ্চের সামনেই কারখানার প্রশস্ত সিঁড়ি। সিঁড়িগুলোকে ব্যবহার করা হয় দর্শকদের বসার জায়গা হিসেবে, যা উন্মুক্ত গ্যালারি। দুটি সিঁড়িতে একসঙ্গে হাজারখানেক দর্শক বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন। বিশেষ বিশেষ দিনে শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজন করা হয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা অংশ নিয়ে থাকেন। 

প্রতিদিন দিন-রাতে দুই শিফটে এখানে শতরঞ্জি বোনেন প্রায় ছয় হাজার নারী-পুরুষ, যার ৯০ শতাংশই নারী। শ্রমিকদের সেবার জন্য সেখানে রয়েছে সেবা বিভাগ। একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে বিনা মূল্যে তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। মাসিক বেতন ও লেনদেনে শ্রমিকেরা যাতে খুব সহজে ব্যাংকিং সুবিধা পান, সে জন্য তাঁদের হাতের কাছেই রয়েছে এটিএম বুথ। সুন্দর পরিবেশে খাবারের ক্যানটিন রয়েছে। কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকেরা কারখানায় তাঁদের সন্তানদের নিয়ে যেতে পারেন। সে জন্য রয়েছে চাইল্ড কেয়ার। শিশুদের দুধ ও খাবার দেওয়া হয় বিনা মূল্যে। 

 ‘কারুপণ্য’ দেশের রপ্তানিতে অন্যান্য অবদানের জন্য হস্তজাতশিল্প পণ্য রপ্তানি খাতে আটবার সেরা রপ্তানিকারক হিসেবে ট্রফি অর্জন করেছে। 

সফিকুল আলম সেলিমের বাড়ি রংপুরের গুপ্তপাড়ায়। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর স্ত্রী সুরাফা হোসেন। সন্তান দুটি। 

সফিকুল সেলিম বললেন, শতরঞ্জি এখন শুধু রংপুরের ঐতিহ্য নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। রংপুরের অজপাড়াগাঁ থেকে শুধু যে হস্তশিল্প রপ্তানি হচ্ছে তা নয়, এখানকার হতদরিদ্র মানুষও কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অভাব দূর হচ্ছে। সুযোগ পাচ্ছেন। অভাব দূর হচ্ছে।