ক্ষুদ্র ব্যবসায় থাকলেও বড় বিনিয়োগে নেই নারীরা

>
স্বর্ণলতা রায়, সভাপতি সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্র
স্বর্ণলতা রায়, সভাপতি সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্র

সিলেটে নারীদের বিনিয়োগের পরিবেশ, সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং নিজের ব্যবসা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি স্বর্ণলতা রায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমনকুমার দাশ।

প্রথম আলো: ব্যবসায় কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?

স্বর্ণলতা রায়: ১৯৯৩ সালে স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করি। এরপর স্নাতকোত্তর পড়ার সময় রূপালী ব্যাংকে চাকরি হয়। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংকে কাজ করেছি। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাইতেন না, আমি চাকরি করি। পারিবারিক চাপে পড়ে একসময় চাকরি ছেড়ে দিই। ২০০০ সালে আমি দুবাই ভ্রমণে যাই। সেখানে ফিলিপাইনের এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর উৎসাহে ত্বকের ওপর কাজ করার আগ্রহ জন্মায়। ঢাকায় ফিরে সে বিষয়ে একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছি। প্রথম দিকে বাসায় কাজ শুরু করি। এরপর ২০০৪ সালে সিলেটের মীরের ময়দান এলাকায় এক বান্ধবীর সঙ্গে মিলে ‘উইমেন্স ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড’ নামের বুটিক হাউস ও পারলার চালু করি। দুই বছর পর নগরের লামাবাজার এলাকায় এককভাবে আরেকটি পারলার চালু করি।

প্রথম আলো: উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমে কী করা প্রয়োজন?

স্বর্ণলতা রায়: উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে একাগ্রতা ও দক্ষতা সবার আগে থাকা প্রয়োজন। একজন উদ্যোক্তার কাছে সর্বশেষ ব্যবসায়িক সংক্রান্ত তথ্য থাকা এবং শহরের অপরাপর ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা থাকাও দরকার। ভালো উদ্যোক্তা হতে চাইলে—বাজারের চাহিদা, সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো নখদর্পণে থাকতে হবে। তবেই সফল হওয়া সম্ভব।

প্রথম আলো: সিলেটে নারীদের বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন? সিলেটে কতজন নারী উদ্যোক্তা আছেন?

স্বর্ণলতা রায়: সিলেটে ক্ষুদ্র ব্যবসায় অনেক নারী আছেন। সংখ্যায় এক হাজারের বেশি হবে। যদিও সবাই ট্রেড লাইসেন্স কিংবা টিআইএনের আওতায় নেই। তবে সরকারি নীতিমালা মেনে যেন নারীরা ব্যবসায় আসেন, তা নিশ্চিতে আমরা বিভিন্ন সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায় সম্পৃক্ত নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। আমাদের সংগঠনে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন, তাঁরা সবাই করদাতার তালিকায় রয়েছেন। সিলেটের অনেক নারী ঘরে বসেই ব্যবসা করেন। নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পাটজাত দ্রব্য ও সূচিশিল্পের সঙ্গে নারীরা জড়িত। চামড়াজাত পণ্য, বুটিক, পারলারের সঙ্গেও অনেকে জড়িত রয়েছেন। এ ছাড়া সিলেটের কয়েকজন নারী ঠিকাদারি ব্যবসা করেও সফল হয়েছেন।

প্রথম আলো: ব্যবসায় নারীদের কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা সমস্যার মুখে পড়তে হয়?

স্বর্ণলতা রায়: নারীর সামনে সম্ভাবনার মতো প্রতিবন্ধকতাও আছে। সরকার নারীদের জন্য বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে আন্তরিক। তবে সরকারের নীতিসংক্রান্ত তথ্যগুলো সব সময় আমাদের কাছে পৌঁছায় না। এতে নারীরা পিছিয়ে পড়ে। তথ্যের এ ঘাটতি দূর করা গেলে বিনিয়োগে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স ফি কমালে বিনিয়োগে নারীরা আরও উৎসাহিত হবেন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের নির্মিতব্য মার্কেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দোকান বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।   সিলেটে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা থাকলেও বড় বিনিয়োগে নারীদের সেভাবে পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে অর্থসংকটের পাশাপাশি অভিজ্ঞতারও অভাব রয়েছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নারীদের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করতে নানামুখী কর্মসূচি নিতে হবে।  আশার কথা হচ্ছে, আগের চেয়ে এখন অনেক নারী সিলেটে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। সিলেটে হাইটেক পার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। আমাদের দাবি ছিল নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সেখানে কম মূল্যে আলাদা প্লট বরাদ্দ দেওয়ার। কিন্তু যে মূল্যে প্লট দেওয়া হচ্ছে, তা কোনো নারীর পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব নয়।

প্রথম আলো: ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয়ব্যাংকঋণ কি পান? ঋণ পেতে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় কি?

স্বর্ণলতা রায়: নারীদের জন্য ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া কিংবা সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। ব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করা নতুন নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে অনেক নারী উদ্যোক্তা ঋণ পান না। যদিও ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, অনেক নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে তারা ঋণের জন্য সঠিক তথ্য ও কাগজপত্র পান না। আবেদনে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। তাই কীভাবে ঋণ আবেদন করতে হয়, ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলে নারীদের জন্য এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারে।

প্রথম আলো: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

স্বর্ণলতা রায়: শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি না পেয়ে কোনো তরুণ-তরুণী যেন হতাশ না হন, সেটাই তরুণদের প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ। এ জন্য আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের নিয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার করছি। তরুণদের আমরা বলি, স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করুন। তাতেই সফলতা আসবে। সিলেট অঞ্চলের বাঁশ-বেতের ব্যবহার কমে যাচ্ছে, অথচ এসব পণ্যসামগ্রীর একটি সমৃদ্ধ কুটিরশিল্পের ধারা এখানে ছিল। এটিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা যেতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেক তরুণী এখন উদ্যোক্তা হতে আসছে। তাদের জন্য পরামর্শ, স্থানীয় চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে বিনিয়োগে একাগ্রতার সঙ্গে মনোনিবেশ করতে হবে।