২৪ দিন অর্থ চুরির তথ্য গোপন রাখেন আতিউর রহমান

পদত্যাগের আগে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর গুলশানের বাসভবনে।  ফাইল ছবি
পদত্যাগের আগে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর গুলশানের বাসভবনে। ফাইল ছবি

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চুরির তথ্য ২৪ দিন পর্যন্ত সরকারের কাছে গোপন রেখেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আতিউর রহমান।

ফরাসউদ্দিন কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলেছে, অর্থ চুরির তথ্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই, বরং গর্হিত অপরাধ। আর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানানোটা অসদাচরণ।

 রিজার্ভ চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই চুরির বিষয়ে নিশ্চিত হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার দুপুরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী কাউকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়নি। এর কারণ জানতে চেয়েছিল তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম তথ্য গোপনের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা ধরা পড়ে ৬ ফেব্রুয়ারি, শনিবার। অর্থ চুরির ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পরে শনিবার দুপুরে তিনি বিষয়টি গভর্নর আতিউর রহমানকে জানান এবং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে জিডির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাঠানোর জন্য তিনি বলেন। কিন্তু গভর্নর তাঁকে জানান, জিডি করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হবেন এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। আর অর্থমন্ত্রী কোথায় কী বলে ফেলেন ঠিক নেই। এমনকি অভ্যন্তরীণ তদন্তও গোপনে করার জন্য তিনি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। 

তদন্ত কমিটির কাছে তথ্য গোপন রাখার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আতিউর রহমান। তিনি বলেছেন, তাঁর বন্ধু ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো এম তেরেঙ্গার সঙ্গে তিনি টেলিফোনে কথা বলেছেন। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তাঁকে বলেছেন, জানাজানি হলে অপকর্মকারীরা পালিয়ে যাবে; বরং গোপন থাকলে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে। 

এ বিষয়ে ফরাসউদ্দিন কমিটির মন্তব্য হচ্ছে, একজন বিদেশি কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ও অনিশ্চিত আশ্বাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিষয়টি কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষকে, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের দ্য ইনকুয়ারার পত্রিকায় বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সংবাদ প্রকাশিত হলে ১ মার্চ গভর্নর গোয়েন্দা সংস্থাকে জানান। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠান এবং ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।

সরকারকে না জানানোর বিষয়ে ব্যাখ্যা পেতে আতিউর রহমানকে কমিটির সঙ্গে যেকোনো দিন, যেকোনো স্থানে সাক্ষাতের অনুরোধ করেছিল ফরাসউদ্দিন কমিটি। কিন্তু এ অনুরোধ তিনি রাখেননি। এর কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘মিডিয়া তাঁর ওপর চড়াও হয়ে যাবে, তাই বাসভবনের বাইরে তিনি যেতে চান না।’ 

 তদন্ত কমিটি সামগ্রিক বিষয়টি অযৌক্তিক, গর্হিত অপরাধ এবং অসদাচরণ বলে মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, এসব গুরুতর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অন্য সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও নির্লিপ্ততা সত্যিই বিস্ময়কর।

এ নিয়ে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

সব শেষে তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘স্বাধীনতার ৪৪ বছরে ১২ জন অর্থমন্ত্রী ও ১০ জন গভর্নর কাজ করেছেন। অর্থমন্ত্রী-গভর্নর মতান্তর, এমনকি মনান্তর আগেও ঘটেছে। তবে এবার এটি যেভাবে দ্বন্দ্বে রূপ নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে, তা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত, অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং দেশের সুশাসন ও সুনামের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক।’ 

(বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন পড়ুন প্রথম আলো পত্রিকায়)