যেখানে সমস্যা সেখানে ব্যবসাও

ভূমিজ-এর ফারহানা রশিদ। ছবি: সংগৃহীত
ভূমিজ-এর ফারহানা রশিদ। ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো নতুন উদ্যোগ সফল হওয়ার অব্যর্থ উপায় হচ্ছে, কোনো সত্যিকার সমস্যা সমাধান করা। তখন আর ভাবতে হয় না, কীভাবে উদ্যোগটা আয় করবে। কারণ এ খাতে ব্যয় করার জন্য হাতে টাকা নিয়ে বসেই আছে মানুষ। স্থাপত্য সংস্থা ভূমিজ-এর পাবলিক টয়লেটের উদ্যোগটি ঠিক এই পথেই সফলতা পেয়েছে। 

ভূমিজ পাবলিক টয়লেট তৈরি করে। কাজটি করে খুব সুলভে, গ্রাহকের বাজেট এবং স্থানের পরিমাণ মাথায় রেখে। কখনো সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজও তারাই করে। এই দুই কাজে যে টাকা আসে, সেটাই আসলে তাদের ব্যবসা। 

ঢাকায় ভূমিজের ছয়টি পাবলিক টয়লেট আছে। গাউছিয়া মার্কেটের নূর ম্যানশনের তৃতীয় তলার মহিলা টয়লেট, কল্যাণপুরের কমিউনিটি টয়লেট, ওয়াটার এইডের সঙ্গে নাবিস্কো, সাতরাস্তা ও ট্রাকস্ট্যান্ডে আরও তিনটি পাবলিক টয়লেট এবং সর্বশেষটি গুলশান ২ নম্বরে। 

এ ছাড়া তারা নকশা করে দিয়েছে, এমন টয়লেট আছে রংপুরে দুটি, নারায়ণগঞ্জে দুটি, কাজ চলছে কুষ্টিয়া ও ঢাকার এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে। 

 কথা হয় ভূমিজের কর্ণধার ফারহানা রশিদের সঙ্গে। ফারহানা পেশায় স্থপতি। লেখাপড়া করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় এবং সুইডেনে টেকসই নগরপরিকল্পনা বিষয়েও। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেছেন এমন এক বিজনেস মডেল, যা মানুষের পাবলিক টয়লেটের সমস্যা সমাধান করবে। 

ফারহানা বলেন, ‘পাবলিক টয়লেট তৈরির বিষয়টি শুধু আমার শিক্ষা বা ব্যবসার অংশ না। এর সঙ্গে আমার একটি আবেগ জড়িয়ে আছে। আমার ছোট খালা মারা গেছেন কিডনিজনিত সমস্যায়। বাড়ির বাইরে টয়লেটে যাওয়া সমস্যা, এ কারণে তিনি দীর্ঘদিন বাইরে বের হলেও টয়লেটে যেতেন না। এর প্রভাব পড়ে তাঁর কিডনিতে এবং খুব কম বয়সেই তিনি চলে যান।’

লেখাপড়ার কাজ করতে গিয়ে ফারহানা জরিপ করে দেখেছেন, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (রেচনপ্রক্রিয়ার কোনো না কোনো অংশে প্রদাহ) রয়েছে। সেই থেকে তাঁর মনে হয় এ সমস্যাটার সমাধান করলে কেমন হয়? 

ফারহানা একটা পাবলিক টয়লেটের ব্যবসায়িক বা বিজনেস মডেল দাঁড় করান। কিন্তু সমস্যা অর্থায়নের। এর মধ্যেই ২০১৬ সালে ব্র্যাকের আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ জিতে আসে তাঁর পাবলিক টয়লেটের বিজনেস মডেল। সেখান থেকে পুরস্কার পাওয়া ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গাউছিয়া মার্কেটের নূর ম্যানশনের তৃতীয় তলার পাবলিক টয়লেটটিকে আধুনিক টয়লেটে রূপান্তর করেন তিনি। 

চোখের সামনে যখন এই অদ্ভুত বিজনেস মডেল দাঁড়িয়ে যায়, তখন এতে বিশ্বাস হতে থাকে মানুষের। ডিজাইনে সহযোগিতা চায় ওয়াটার এইড এবং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। ফারহানা জানালেন, ‘এমনকি নূর ম্যানশনের পাবলিক টয়লেটগুলো পুনর্নির্মাণের সময়ও আমাদের সহযোগিতা চায় মার্কেট কর্তৃপক্ষ, এরা সবাই এখন ভূমিজের গ্রাহক।’ 

ভূমিজের টয়লেটগুলো বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায় না। ফারহানা বলেন, ‘টয়লেট ব্যবহার কোথাওই বিনা মূল্যে হওয়া উচিত নয়। এতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হয়।’ ব্যবহারের খরচ ১০ টাকা।

নূর ম্যানশনের টয়লেটটিতে বাচ্চাদের ডায়পার পরিবর্তন থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাডের ব্যবস্থা, বসার জায়গা, ব্যাগ রাখার জায়গাসহ ইত্যাদি সুবিধা রাখা হয়েছে। ফারহানা বলেন, ‘আমরা ডিজাইন করার সময় এটাই মাথায় রাখি যে টয়লেট জায়গাটা যেন সর্বোচ্চ আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যসম্মত হয়। আগে এ টয়লেটটি খুব নোংরা–ঘিঞ্জি একটা জায়গা ছিল। তার বদলে এখন আলো-বাতাস আসে, এমন একটা টয়লেট বানানো হয়েছে।’

সব মিলিয়ে ভূমিজ এখন পর্যন্ত ব্যবসাসফল একটি প্রতিষ্ঠান। তবে টয়লেট নির্মাণের ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবসাটা এখনো খুব সোজা চোখে দেখা হয় না পরিবারে, হেসেই জানিয়ে দেন ফারহানা। বলেন, ‘একদিন আমার মা আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুই কী কাজ করিস? আমি জবাব দিলাম আমি আর্কিটেক্ট ডিজাইন করি। মা বললেন, তাহলে অমুকে যে বলল তুই টয়লেটে কাজ করিস?’ 

যদিও কে কী ভাবল, তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন ফারহানা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি উচ্চতর শিক্ষা বা উন্নত দেশের নামী প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ খোঁজেননি। তিনি নিজের শিক্ষা দিয়ে দেশের কাজে লাগাতে চান।

ফারহানা বিশ্বাস করেন, একটা নগরকে বাসযোগ্য করতে হলে এর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে হবে। সব আয়ের মানুষের জন্য যখন মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, তখনই ঢাকা একটি আধুনিক শহর হয়ে উঠবে।