উন্নতিতে সেরা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

বিদ্যুৎ
বিদ্যুৎ

বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে’ এবার বেশ ভালো করবে বাংলাদেশ। আগামী মাসের শেষ দিকে সহজে ব্যবসা সূচক প্রকাশের আগে এবার সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে—এমন ২০টি দেশের তালিকা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তালিকায় বাংলাদেশও আছে।

বিশ্বব্যাংকের এ সূচকটিতে উন্নতির জন্য কয়েক বছর ধরে কাজ করছে সরকার। কিন্তু উন্নতি তেমন একটা হচ্ছিল না। বরং গত বছরের প্রতিবেদনে আফগানিস্তান বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে সামনে চলে যায়। ভারতও এ ক্ষেত্রে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। অবশেষে এবার উন্নতির আশা দেখছে বাংলাদেশ।

সহজে ব্যবসা সূচকের মাধ্যমে কোনো দেশে ব্যবসা করা কতটা সহজ, তা প্রকাশ পায়। মনে করা হয়, বিদেশি বিনিয়োগ করার আগে দেশ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের এ সূচকটি বিবেচনায় আসে। বাংলাদেশ এখন এ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। এবার বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই অবস্থানের উন্নতি হতে পারে। এখন সূচকে মালয়েশিয়া ১৫, চীন ৪৬, ভিয়েতনাম ৬৯, শ্রীলঙ্কা ১০০ ও পাকিস্তান ১৩৬তম। আফগানিস্তানের অবস্থান ১৬৭তম।

মোটাদাগে মোট ১০টি ভিত্তির ওপর বিশ্বব্যাংক ডুয়িং বিজনেসের র‍্যাঙ্কিং বা ক্রমতালিকা তৈরি করে। এগুলো হলো ব্যবসা শুরুর অনুমোদন, ভবন নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎ–সংযোগ, ভূমি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর প্রদান, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া। এসব প্রক্রিয়ায় জটিলতা, ব্যয় বেশি হওয়া ও দীর্ঘসূত্রতা একটি দেশের পিছিয়ে থাকার কারণ।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া সহজ করেছে। বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া ও ঋণপ্রাপ্তির দিক দিয়ে উন্নতি করেছে। নতুন কোম্পানি নিবন্ধনে বাংলাদেশ খরচ কমিয়েছে। ডিজিটাল সনদে ফি বা মাশুল আর নিচ্ছে না। ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) ঋণ তথ্যের আওতা বাড়িয়েছে। যেখানে এখন পাঁচ বছরের তথ্য পাওয়া যায়, সেটা ঋণের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন।

বাংলাদেশের পাশাপাশি উন্নতিতে সেরা ২০টি দেশের তালিকায় রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, আজারবাইজান, বাহরাইন, জিবুতি, জর্ডান, কেনিয়া, কসোভো, কুয়েত, কিরগিজ প্রজাতন্ত্র, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, কাতার, সৌদি আরব, তাজিকিস্তান, টোগো, উজবেকিস্তান ও জিম্বাবুয়ে। এ তালিকায় কোন দেশ বেশি উন্নতি করেছে, তা প্রকাশ করেনি বিশ্বব্যাংক। ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদনে ক্রমতালিকা করা হয়েছে দেশের নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নতিতে নেওয়া কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর ঢাকা কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বিভাগের প্রধান মাশরুর রিয়াজ গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এ সূচকে উন্নতির জন্য যে সংস্কার কর্মসূচি নিয়েছিল, তার সুফল এটি। এখন আশা করা যায়, বাংলাদেশ এবারের সূচকে উন্নতি করবে। তবে কতটা, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়।

২০১৬ সাল থেকে চেষ্টা

বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালে যে ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। এরপর থেকে বাংলাদেশ শুধু পেছাচ্ছিল।

সরকার ব্যবসা সহজ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয় ২০১৬ সালে। দায়িত্ব দেওয়া হয় নবগঠিত সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা)। সংস্থাটির তখনকার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম ওই বছর ১৯ নভেম্বর সোনারগাঁও হোটেলে সচিবদের নিয়ে এক সভায় জানান, বাংলাদেশে এ সূচকে ২০২১ সালের মধ্যে দুই অঙ্ক, অর্থাৎ কমপক্ষে ৯৯তম অবস্থানে নিয়ে আসার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

এরপর বিডা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কী কী সংস্কার আনতে হবে, কার কাজ কী, তা ঠিক করে। সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনাও করা হয়। কিন্তু সরকারের অনেক সংস্থা এ ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। বিষয়টি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়ও পড়েছে। ফলে সংস্কার তেমন একটা হয়নি। ২০১৭ সালের সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে যায়। পরের বছর মাত্র এক ধাপ উন্নতি হয়। অবশ্য শেষের দিকে কিছু সংস্কার হয়েছে, যার সুফল এ বছর মিলতে পারে।

কী কী সংস্কার

বিডা জানায়, সহজে ব্যবসা সূচকে উন্নতির জন্য ব্যবসা শুরু করতে অনুমোদনের প্রক্রিয়াগত কাজ করার সময় সাড়ে ১৯ দিন থেকে কমিয়ে ১১ দিনে আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যয়ও কমানো হয়েছে। কোম্পানির নাম অনুমোদন, সনদ দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাশুল কমানো হয়েছে। ফলে ব্যবসা শুরুর অনুমোদনগত প্রক্রিয়ায় ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেশের মাথাপিছু আয়ের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগে ২১ শতাংশ ছিল। একইভাবে ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া ৯টি থেকে কমিয়ে ৭টি করা হয়েছে।

কারখানা করার জন্য নির্মাণকাজের অনুমতি পেতে আগে ২৮১ দিন সময় লাগত। এখন সেটা কমিয়ে ৭৬ দিনে আনা হয়েছে। অনুমোদনের প্রক্রিয়া ১৬টি ধাপ থেকে কমিয়ে ৬টিতে আনা হয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে ব্যয় একটি পণ্যাগার বা ওয়্যারহাউস নির্মাণের মোট ব্যয়ের ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে।

বিদ্যুৎ–সংযোগ প্রাপ্তির ভোগান্তিও কমানো হয়েছে। বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে ১৪৮ দিন লাগত। এখন সেটা কমে ১০৭ দিন লাগছে। এর মানে হলো ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে প্রক্রিয়া ৯টি থেকে কমিয়ে ৭টি করা হয়েছে।

ভূমি নিবন্ধনও সহজ করেছে বাংলাদেশ। জমির নামজারি বা মিউটেশনের সময় কমে ৫৬ দিনে নামানো হয়েছে, আগে যা ১০৬ দিন ছিল। জমির সীমানা, নকশা ও অন্যান্য তথ্য নিয়ে ইলেকট্রনিক তথ্যভান্ডার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিডা।

বিডা দাবি করেছে, রপ্তানিতে বন্দরে নথিগত কাজ শেষ করতে সময় ১৬৮ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৩৬ ঘণ্টা, আমদানিতে ২১৬ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে। একইভাবে কমানো হয়েছে ব্যয়। আগে যেখানে রপ্তানিতে বন্দরের প্রক্রিয়াগত ব্যয় ৪০৮ মার্কিন ডলার ছিল, এখন সেটা ২০০ ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। আবার একইভাবে আমদানিতে ব্যয় ৯০০ ডলার থেকে কমিয়ে ২০০ ডলারে আনা হয়েছে।

অবশ্য বিশ্বব্যাংকের আগামী সূচকে উন্নতির জন্য সংস্কারের শেষ সময় ছিল গত ৩০ এপ্রিল। এর মধ্যে যেসব সংস্কারের সুফল মাঠপর্যায়ে মিলেছে, সেগুলোই কেবল এবারের সূচকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কতটুকু উন্নতি হতে পারে

আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশে ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে। তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, যেসব সংস্কার হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ বড় ধরনের উন্নতি করবে।

বিডায় নতুন নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মো. সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, এ বছর বাংলাদেশের উন্নতি হবে। তবে বড় লাফ দেবে মূলত আগামী বছর। তিনি বলেন, ‘আমি বিডায় ৯ সদস্যের একটি কমিটি করেছি। এ কমিটি সহজে ব্যবসা সূচক নিয়ে কাজ করবে। আমরা প্রতি সপ্তাহে অগ্রগতি নজরে রাখব, সে রকম কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে।’

এরপর কী

সর্বশেষ সহজে ব্যবসা সূচকে বাংলাদেশ ব্যবসা শুরুর দিক দিয়ে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৩৮তম অবস্থান পেয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতিতে ১৩৮, বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়ার দিক দিয়ে ১৭৯, ভূমি নিবন্ধনে ১৮৩, ঋণের প্রাপ্যতায় ১৬১, কর পরিশোধের প্রক্রিয়ায় ১৫১, বৈদেশিক বাণিজ্যে ১৭৬, চুক্তির বাস্তবায়নে ১৮৯ এবং দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় ১৫৩তম।

এ বছর কিছুটা উন্নতি হলেও বাংলাদেশের কাজ করার অনেক বাকি। কী কী কাজ করতে হবে, তার তালিকাও আছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আইনি সংস্কার ও মানসিকতার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেতে হবে বহুদূর।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে বিদেশি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শেহজাদ মুনিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই সত্যিকার ওয়ান স্টপ সার্ভিস (এক দরজায় সেবা), যেখানে বিনিয়োগকারী বিডার কাছ থেকে অনলাইনে সব সংস্থার সেবা পাবেন। সেটা কিন্তু এখনো কার্যকর হয়নি।’

শেহজাদ মুনিম মনে করেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বয় বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আনতে চারটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, বিদেশিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে জানানো। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যে থাকা দেশগুলোতে বাংলাদেশি দূতাবাসের সক্ষমতা বাড়ানো। তৃতীয়ত, বিনিয়োগকারী দেশে আসার পর তাঁকে এক দরজায় সেবা দেওয়া এবং চতুর্থত, দেশে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী আছেন, তাঁরা যাতে ভালো অভিজ্ঞতার কথা বলেন, সে ব্যবস্থা করা।