আমদানির বদলে দেশেই মোটরসাইকেলের উৎপাদন

ব্যবহার সহজ। চালাতে খরচও তুলনামূলক কম। তাই ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে উৎপাদিত হওয়ায় দামও মানুষের নাগালে এসেছে। মডেল: তানহা ও রাতুল, ছবি: কবির হোসেন
ব্যবহার সহজ। চালাতে খরচও তুলনামূলক কম। তাই ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশে উৎপাদিত হওয়ায় দামও মানুষের নাগালে এসেছে। মডেল: তানহা ও রাতুল, ছবি: কবির হোসেন
>

মোটরসাইকেল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। চাহিদা বাড়ছে, দামও কমছে। কারণ, দেশেই এখন মোটরসাইকেল শিল্প গড়ে উঠেছে। সাত কোম্পানি এগিয়ে নিচ্ছে এই শিল্প। সামনের কোনো একদিন হয়তো পুরো মোটরসাইকেলই তৈরি হবে দেশের মধ্যে।

২০১৬ সালের জুনে দেশে একটি ব্র্যান্ডের একটি মডেলের মোটরসাইকেলের দাম ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। সেই মোটরসাইকেলটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৭ হাজার টাকায়। এই সাশ্রয়ী দামের কারণে দেশজুড়ে মোটরসাইকেলের বাজার রমরমা।

সাশ্রয়ী দামটা আবার এসেছে দুই কারণে। প্রথমত, দেশে উৎপাদন, সেই কারণে সরকারের শুল্ক ছাড়। দ্বিতীয়ত, বাজার ধরতে আগ্রাসী বিপণন। আমাদের আজকের লেখা দেশে উৎপাদন নিয়ে।

দেশে এখন কমপক্ষে সাতটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের কারখানা হয়েছে; ভারতের বাজাজ, টিভিএস ও হিরো, জাপানের হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা এবং একমাত্র দেশীয় ব্র্যান্ড রানার। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো দেশে কারখানা করেছে কোনো ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে। কোনো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশি কোম্পানি, কারিগরি সহায়তা দিয়েছে মূল প্রতিষ্ঠান।

অবশ্য কারখানাগুলো উৎপাদনের এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। চেসিস বা কাঠামো, কয়েকটি যন্ত্রাংশ তৈরি করলেই উৎপাদক হিসেবে স্বীকৃতি মিলছে। কিন্তু উৎপাদকেরা দেশে সহযোগী শিল্প গড়ে তুলে আরও বেশি মূল্য সংযোজনে মরিয়া।

কয়েক দশক আগে ভারতেও এভাবেই মোটরসাইকেল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি রয়েল এনফিল্ড মাদ্রাজ মোটরসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইতে একটি সংযোজন কারখানা করে। সেই থেকে শুরু। ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ ১৯৪৪ সালে মোটরসাইকেল আমদানির ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা দুই চাকা চাকার যানবাহন উৎপাদনকারী বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তাদের হাত ধরেছিল জাপানের কাওয়াসাকি।

টিভিএসের যৌথ উদ্যোগের কারখানা ছিল জাপানের সুজুকি মোটর করপোরেশনের সঙ্গে। তাদের যৌথ উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। ভারতের হিরো মোটোকর্প আগে সাইকেল উৎপাদন করত। ১৯৮৪ সালে জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তারা মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে।

এখন হিরো, বাজাজ ও টিভিএস ভারতীয় মোটরসাইকেলের সুপরিচিত নাম। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তারা বহু দেশের রাস্তায় চলছে। বাংলাদেশে কি ভারতের মতো মোটরসাইকেল শিল্পের যাত্রাটি শুরু হলো?

শুরুর কথা

বাংলাদেশে শুরুর দিকে জাপানের হোন্ডা ব্র্যান্ডের সামান্য কিছু মোটরসাইকেল আমদানি হতো। এ দেশের মানুষ মোটরসাইকেলকে চিনত হোন্ডা নামেই। এরপর আশির দশকে ভারতীয় ও জাপানের যৌথ উদ্যোগের কারখানায় তৈরি ভারতীয় মোটরসাইকেল বাংলাদেশের বাজারে আসতে শুরু করে।

এরপর শুরু হয় মোটরসাইকেল খোলা অবস্থায় এনে সংযোজন করা, যা দেড় দশকের মতো হলো। এর মাধ্যমে সামান্য কিছু মূল্য সংযোজন হচ্ছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় পেতে উৎপাদনের শর্ত দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উৎপাদনকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে মোটরসাইকেলের মূল কাঠামোসহ (চেসিস) পাঁচটি প্রধান যন্ত্রাংশের কমপক্ষে একটি দেশে উৎপাদন করতে হবে। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় মোটরসাইকেল শিল্পের উন্নয়নে একটি নীতিমালাও করেছে।

এখন দেশে মোটরসাইকেলে তিন ধরনের কর ব্যবস্থা আছে। যে সব প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি করে তাদের ২৮-৩০ শতাংশ কর দিতে হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের চেয়ে কিছু কম মূল্য সংযোজন করে, সে ক্ষেত্রে মোট কর ভার ৫৯ শতাংশের মতো। আর যারা পুরো তৈরি মোটরসাইকেল আমদানি করে, তাদের সব মিলিয়ে ১৫১ শতাংশ কর দিতে হয়। অবশ্য সব কোম্পানিই দু-চারটি করে মডেল তৈরি করে। বাকিটা সংযোজন করে।

সম্ভাবনা বড়

জাপানের বহুজাতিক মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড ইয়ামাহার এক বাজার জরিপ বলছে, দেশে প্রতি ১৬১ জনে একজন মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ হার প্রতি ২০ জনে ১ জন এবং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় প্রতি ৪ জনে ১ জন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। এ হিসেবে বাংলাদেশের বাজারে মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

কারখানায় রানারের মোটরসাইকেল
কারখানায় রানারের মোটরসাইকেল

কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে ২০১৫ সালে ১ লাখ ৮০ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছিল। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ৩ লাখ ৮৭ হাজারে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে বিক্রি দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লাখে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ২০২৩ সালের মধ্যে এ দেশে বাজারের মোটরসাইকেলের বাজার বছরে ১০ লাখে উন্নীত হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে মোটরসাইকেল রপ্তানি হবে, যার শুরু করেছে রানার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হোন্ডা লিমিটেডের অর্থ ও বাণিজ্য বিভাগের প্রধান শাহ মো. আশিকুর রহমান বলেন, সরকার মোটরসাইকেল শিল্পনীতিতে বাজার ২০২৭ সালের মধ্যে ১০ লাখে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। বাস্তবে সেটা অনেক আগেই অর্জিত হবে। তিনি বলেন, এটা খুবই সম্ভাবনাময় শিল্প। সরকারের সহযোগিতা পেলে এ খাত আরও এগিয়ে যাবে।

চার চাহিদা

উদ্যোক্তাদের মত অনুযায়ী, মোটরসাইকেল শিল্পের এখন চারটি চাহিদা। এক. সহযোগী শিল্পের উন্নয়ন, যারা কারখানার জন্য বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করবে। দুই. মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ব্যয় কমানো ও সহজ করা। তিন. মোটরসাইকেল কিনতে ঋণ দেওয়া। চার. চালনার প্রশিক্ষণের জন্য সহায়তা।

বাংলাদেশে ইয়ামাহার কারখানা করা এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, ভিয়েতনামের ভিন ব্যাংক মোটরসাইকেল কিনতে বাজারে আড়াই শ কোটি ডলার ঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশেও ঋণ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে এমন সব শর্ত দেওয়া হয়, যা মেনে শিক্ষার্থী ও বেকারেরা মোটরসাইকেল কিনতে পারে না। তিনি বলেন, ইয়ামাহা অনেক দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে চালকদের লাইসেন্স দেয়। এ ক্ষমতা তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার দিয়েছে। বাংলাদেশে যদি সরকারি কোনো খালি জায়গায় প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে ভালো হতো।

খরচ কম

ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মাঝারি ইঞ্জিন ক্ষমতার একটি মোটরসাইকেল এক লিটার জ্বালানি তেলে ৪০ কিলোমিটারের বেশি চালানো যায়। নগরে গণপরিবহনের দুর্দশায় অনেকেই মোটরসাইকেল বেছে নিচ্ছে। নারীরাও শুধু করেছে স্কুটি চালনা।

অনেকেই মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। অনেকে মোটরসাইকেলে খাবার সরবরাহ করে। তাদেরই একজন সাব্বির হোসেন। তিনি বলেন, দিনে ৬-৭ ঘণ্টা ঠিকমতো চালালে ৮০০ টাকার মতো আয় করা যায়। সেটা দিয়েই তাঁর সংসার চলে। আগে পুরান ঢাকায় একটি দোকানে কাজ করতেন। সেখানে পেতেন ১০ হাজার টাকা।

অনেকেই ট্রাফিক আইন না মানার মোটরসাইকেল চালকদের অভিযুক্ত করেন। জবাব কি, জানতে চাইলে সাব্বির হোসেন বলেন, দেশে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, অটোরিকশা—কেউ-ই ঠিকমতো আইন মানে না। এটা গাড়ির দোষ নয়, দোষ ট্রাফিক ব্যবস্থার।