এক টাকাও খরচ হয়নি ৯ প্রকল্পে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার লিংক রোড থেকে লাবণী মোড় পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এ জন্য খরচ ধরা হয় ২৮৮ কোটি টাকা। আড়াই বছর মেয়াদি এই প্রকল্প ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই প্রকল্পের কাজে যেমন কোনো অগ্রগতিই নেই, তেমনি এক টাকাও খরচ হয়নি। তবে মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে নেওয়া এই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, এটিই কেবল অগ্রগতির খবর। ৩২ মাসে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও ইতিমধ্যে প্রকল্পটির ১০ মাস সময় চলে গেছে, এখনো ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটির জন্য নামমাত্র বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা-ও খরচ হয়নি। 

জানতে চাইলে এই প্রকল্পের পরিচালক হাফিজুর রহমান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী সপ্তাহের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ হয়ে যাবে। সম্প্রতি আমি এই প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েই ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া জোরদার করেছি। তবে বিদ্যমান সড়কটি চলাচলের জন্য অত খারাপ নয়। যেহেতু পর্যটন নগরী, তাই সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পাশাপাশি সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে।’ 

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় কোটি টাকা। প্রতিবছর এ রকম বরাদ্দ দেওয়া হলে প্রকল্পটি শেষ করতে ১৯২ বছর লাগবে! 

চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়া-চন্দনাইশ-বরকল-আনোয়ারা সড়কের চাঁদখালী নদীর ওপর বরকল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। তখন সেতুর নকশাও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থ বরাদ্দে সংকটসহ নানা কারণে তখন প্রকল্পটি পাস করা সম্ভব হয়নি। এভাবে আট বছর চলে যায়। সর্বশেষ গত মে মাসে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা খরচের এই প্রকল্প পাস করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন। গত অর্থবছরে প্রকল্পটি পাস হলেও তখন সংশোধিত এডিপিতে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। চলতি অর্থবছরের এডিপিতেও কোনো বরাদ্দ নেই। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চলতি অর্থবছরের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে মাত্র এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার। এভাবে বরাদ্দ দিলে এই সেতু নির্মাণ করতে আরও ৩৮ বছর লাগবে। 

কেন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দুর্দশা—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক সুমন সিংহ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটির মেয়াদ গত ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প পাসের পর পরিকল্পনা কমিশন থেকে আদেশ হাতে পেয়েছি গত জুন মাসে। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দও হাতে পাইনি।’ তিনি জানান, সেতুর নকশা ২০১০ সালে করা হয়েছিল। গত আট বছরে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসহ স্রোতোধারা পরিবর্তন হয়েছে—এই বিবেচনায় পুরোনো নকশা যাচাই-বাছাই করতে আরও দুই মাস পার হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে। 

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় এ ধরনের নয়টি প্রকল্প আছে, যেগুলোতে এখনো এক টাকাও খরচ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন মেয়াদের ১ থেকে ৩ বছর সময় পার করে ফেলেছে। একটি ছাড়া সব কটি প্রকল্প ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রেও জানা গেছে, সব কটি প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে এখনো ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। 

চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘শূন্য’ অগ্রগতির বাকি সাতটি প্রকল্প হলো—৮০ কোটি টাকার কেরানিহাট-সাতকানিয়া-গুনাগরী জেলা মহাসড়ক প্রশস্তকরণ; ৫৩৪ কোটি টাকার চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়কের হাটহাজারী থেকে রাউজান পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, ৪০০ কোটি টাকার হাটহাজারী-ফটিকছড়ি-মানিকছড়ি-মাটিরাঙ্গা-খাগড়াছড়ি সড়ক উন্নয়ন; ৯৭ কোটি টাকার মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি-জ্বালিয়াপাড়া সড়কের সিন্দুকছড়ি থেকে মহালছড়ি পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন; ১৯০ কোটি টাকার খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়কে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ; ১,২৭০ কোটি টাকার সিপিজিসিবিএল-সুমিটোমো ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ এবং ৬৬২ কোটি টাকার সোনাগাজী ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে সংযোগ সেতু নির্মাণ। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংযোগ সেতুটি ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। 

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দক্ষতার অভাবে এভাবেই প্রকল্পগুলো আটকে যায়। সময়মতো প্রকল্প শেষ না হলে খরচ বাড়ে, অর্থনৈতিক সুবিধা কমে যায়। তিনি সুপারিশ করেন, মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) আওতায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ই জানে, আগামী কয়েক বছর তারা কত টাকা বরাদ্দ পাবে। তাই এসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পক্ষে যেকোনো প্রকল্পে ক্রয় পরিকল্পনা করা সহজ হয়। তাই বাজেটে পাস হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে দরপত্র আহ্বান করে অল্প সময়ের মধ্যে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া সম্ভব হবে। 

আরও ১৯ প্রকল্প

চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরও ১৯টি প্রকল্প আছে, যেগুলোর মেয়াদ দু-তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়নে খুবই ধীর গতি। এসব প্রকল্পে ১০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি। বেশির ভাগ প্রকল্পই বিদ্যুৎকেন্দ্র, সড়ক-সেতু নির্মাণের প্রকল্প। আগামী ২০২১ ও ২০২২ সালের মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। 

গত ২২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান চট্টগ্রাম বিভাগে প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি এসব কম অগ্রগতির প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। 

চলতি অর্থবছরের এডিপিতে চট্টগ্রাম বিভাগের ১৮৮টি প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে ৯ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জুলাই-আগস্ট মাসে মাত্র ১ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।