অস্থির বাজারে লাভ মজুতদারের লোকসান কৃষক আর ব্যাপারীর

মুন্নাফ প্রামাণিক স্বত্বাধিকারী, মেসার্স মুন্নাফ ট্রেডার্স, বেড়া, পাবনা
মুন্নাফ প্রামাণিক স্বত্বাধিকারী, মেসার্স মুন্নাফ ট্রেডার্স, বেড়া, পাবনা
>

দেশে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় পাবনার সুজানগর ও সাঁথিয়ায়। এ ছাড়া বেড়া উপজেলায়ও প্রচুর পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। পেঁয়াজের বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন মেসার্স মুন্নাফ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মুন্নাফ প্রামাণিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেড়া (পাবনা) প্রতিনিধি বরুণ রায়

প্রথম আলো: হঠাৎ পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ল কেন?

মুন্নাফ প্রামাণিক: পাবনার সুজানগর ও সাঁথিয়া উপজেলায় যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, দেশের অন্য কোনো উপজেলায় তা হয় না। এবার মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলার আগে শিলাবৃষ্টিতে প্রচুর পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই পেঁয়াজের দাম যে বাড়বে, তা আমরা আগে থেকে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু দাম যে হঠাৎ এতটা বাড়বে, তা কোনোভাবেই ধারণা করতে পারিনি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালেও আমাদের বাজারে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। ওই দিন দুপুরের পর খবর আসে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। তাতে ৩০ সেপ্টেম্বর সকালেই প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম ওঠে ৩ হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার টাকায়। পেঁয়াজের এ রকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা আমরা বছর পাঁচেক আগেও একবার দেখেছি।

প্রথম আলো: এবার এ এলাকায় পেঁয়াজের ফলন কেমন হয়েছে? আর কৃষকদের লাভই-বা কেমন হয়েছে?

মুন্নাফ প্রামাণিক: এ এলাকায় সাধারণত প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৫০ মণ পেঁয়াজের ফলন হয়। উৎপাদিত পেঁয়াজের মানও দেশের অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে ভালো। কিন্তু এবার বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বেশির ভাগ কৃষক প্রতি বিঘা থেকে ১৫-২০ মণ পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পেরেছেন। সেই পেঁয়াজও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার উপযোগী ছিল না। ফলে কৃষকেরা পেঁয়াজ তোলার পরপরই তা বাজারে বিক্রি করে দেন। তাতে বাজারে আমদানি ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হন। অথচ প্রতি মণ পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮০০ টাকার বেশি। ফলে এবার পেঁয়াজ চাষে কৃষকেরা ব্যাপক লোকসান দিয়েছেন।

প্রথম আলো: স্থানীয় পেঁয়াজের বাজারের এখনকী অবস্থা?

মুন্নাফ প্রামাণিক: স্থানীয় বাজার এখন অস্থিতিশীল। ব্যাপারীরা চরম ক্ষতির মুখে রয়েছেন। ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরে গত সোমবার ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে পেঁয়াজ কিনেছিলেন তাঁরা। সেই পেঁয়াজ ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করতে পারেননি। কারণ, দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় ঢাকার আড়তদারেরা পেঁয়াজ কেনা বন্ধ করে দেন। এখন সেই পেঁয়াজের দাম সাড়ে তিন হাজার টাকার নিচে নেমে এসেছে। ফলে ব্যাপারীদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে।

প্রথম আলো: পাবনার পেঁয়াজ দেশের কোন এলাকায় যায়? ভারতীয় পেঁয়াজ এখানে আসে কি?

মুন্নাফ প্রামাণিক: আমাদের এখানকার হাটে স্থানীয় পেঁয়াজ ছাড়া অন্য কোনো পেঁয়াজ বিক্রি হয় না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা এখানে পেঁয়াজ কিনতে আসেন। এখানকার বেশির ভাগ পেঁয়াজই যায় ঢাকায়। এ ছাড়া চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য এলাকার ব্যাপারীরা এখান থেকে পেঁয়াজ কেনেন। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢাকা ও চট্টগ্রামে যায়। প্রতি ট্রাকে ১৫ টন করে পেঁয়াজ ধরলে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ টন পেঁয়াজ এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়।

প্রথম আলো: হঠাৎ পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সুফল কারা পেয়েছেন বলে আপনি মনে করেন?

মুন্নাফ প্রামাণিক: আসলে অস্থির বাজারে লাভ মজুতদারেরই বেশি। আর লোকসান হয় কৃষক ও ব্যাপারীর। তবে মজুতদারদেরও যত লাভ হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, ততটা নয়। কারণ, মজুত বা সংরক্ষণ করার উপযোগী পেঁয়াজ ভালো মানের হতে হয়। আর সেসব পেঁয়াজ বেশি দামে কিনতে হয় মজুতদারদের। এবারের মজুত করা পেঁয়াজ অন্যবারের চেয়ে বেশি নষ্ট হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মজুত করা পেঁয়াজের অর্ধেকই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মজুতদারদের প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম এমনিতেই দুই হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তাঁদের লাভের পরিমাণও কমেছে।

প্রথম আলো: পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে বলে মনে করছেন?

মুন্নাফ প্রামাণিক: স্বাভাবিক বলতে যদি পেঁয়াজের দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে আসার বিষয়টি বুঝিয়ে থাকেন, তবে আমার হিসাবে আরও আড়াই থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এ এলাকায় নতুন পেঁয়াজ বাজারে ওঠার কথা। কিন্তু এবার বৃষ্টি ও বন্যার কারণে পেঁয়াজ লাগাতে দেরি হয়েছে। তাই সেই পেঁয়াজ বাজারে উঠতেও দেরি হবে। আমার ধারণা, ডিসেম্বরের শেষের দিকে নতুন পেঁয়াজ বাজারে উঠবে। আর তখনই পেঁয়াজের দাম সবার নাগালের মধ্যে আসবে বলে আমার মনে হয়।