পাঁচ কুখ্যাত বাণিজ্যযুদ্ধ

চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে সংঘটিত আফিম যুদ্ধের একটি চিত্র
চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে সংঘটিত আফিম যুদ্ধের একটি চিত্র

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ। এতে কার কত ক্ষতি হতে পারে, সে হিসাব নিয়ে ব্যস্ত সব দেশ। কারণ, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যতবারই বাণিজ্যযুদ্ধ হয়েছে, ততবারই তা প্রভাব ফেলেছে বিশ্বের কোনো না কোনো বড় অংশে।

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বাণিজ্যযুদ্ধ কিন্তু নতুন ধারণা নয়। বহুবার বহু দেশ শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।

আফিম যুদ্ধ

চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল প্রথম আফিম যুদ্ধ বা ফার্স্ট ওপিয়াম ওয়ার। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন ছিল কৃষিপ্রধান স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ফলে আমদানিতে তাদের ছিল প্রবল অনাগ্রহ। তারা শুধু সোনা, রুপা আর আফিম আমদানি করত। সে সময় আফিম যে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা জানত না চীনারা। তারা আফিম ব্যবহার করত ছোটখাটো রোগের চিকিৎসার ওষুধ হিসেব। এই আফিম আসত মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।

এদিকে ব্রিটিশ বণিকদের কাছে চীনের চা, সিল্ক এবং চিনামাটির বাসন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু চীনারা কেবল রৌপ্যের বিনিময়ে তাদের পণ্য বিক্রি করত। ফলে ব্রিটেনের প্রচুর রুপা চীনের কাছে চলে যায়। এটা বন্ধ করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও অন্য ব্রিটিশ বণিকেরা ভারতে উৎপাদিত আফিম অবৈধভাবে চীনে পাচার করতে শুরু করে। এর বিনিময়ে তারা রুপা নিত। সেই রুপা দিয়ে চীনের চা, সিল্ক কিনত। একসময় চীনের জনগণ ব্রিটিশদের কাছ থেকেই আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা শেখে। ফলে আফিমের চাহিদা আরও বেড়ে যায় চীনে।

আফিমের এই মারাত্মক অবস্থা বুঝতে পেরে চীনের তৎকালীন প্রতাপশালী রাজা চিয়াচিং আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তত দিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আফিম সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন অনেক রাজকর্মচারীও। এমন পরিস্থিতিতে রাজা ক্যান্টন বন্দরে লিনসে-সু নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন। ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ লিনসে-সু ক্যান্টন শহরের বিদেশি বাণিজ্য অঞ্চল অবরোধ করেন। তিনি বেআইনিভাবে রক্ষিত ব্যাপক পরিমাণ আফিম জব্দ করেন। আফিম ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চীন আক্রমণ করে ব্রিটিশরা। চীন সেই যুদ্ধে হেরে যায়। চীনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বন্দর ব্রিটিশদের ছেড়ে দিতে হয়। সেই সঙ্গে পুরো চীনে ব্যবসা করার অনুমতি এবং হংকংকে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে।

স্মুট–হাউলি আইন

শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকাতে এবং অভ্যন্তরীণ শিল্পকে রক্ষা করতে ১৯৩০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুভার ‘স্মুট-হাউলি ট্যারিফ অ্যাক্ট’–এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর রিড স্মুট ও উইলস সি হাউলি। তাঁরা মূলত মার্কিন কৃষি খাতকে রক্ষা করতে এই আইনের প্রবর্তন করেন। তবে প্রেসিডেন্ট হুভার বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ২০ হাজার পণ্য অন্তর্ভুক্ত করে এই আইনের পরিধি বাড়ান। এই আইনের ফলে কয়েক বছর আমদানিনির্ভরতা সাফল্যের সঙ্গে কমাতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে অন্য দেশগুলোর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমে ৬১ শতাংশ। ১৯৩০ সালের ওই স্মুট-হাউলির ট্যারিফ অ্যাক্টের মাধ্যমে যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা অর্থনৈতিক মহামন্দাকে দীর্ঘস্থায়ী করে। পরে ১৯৩৪ সালে পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি আইন কার্যকর করে ওই আইন বাতিল করা হয়। স্মুট-হাউলি আইন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতিকে ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রভাবিত করেছে। এটির কারণে কানাডা-যুক্তরাজ্য নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে বের করে, যার কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে।

মুরগি যুদ্ধ

১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা মুরগির ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে ফ্রান্স ও জার্মানি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা মুরগির দাম ইউরোপের মুরগির থেকে কম হওয়ায় মানুষের কাছে সেটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দ্রুতই প্রতিক্রিয়া দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। ফ্রান্স ও জার্মানির বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে চড়া শুল্ক আরোপ করে তারা। এর মধ্যে ছিল ফ্রান্সের ব্রান্ডি এবং জার্মানির গাড়ি ভক্সওয়াগন। এ যুদ্ধ অনেক দূর গড়িয়েছিল। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক জোট ন্যাটো থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেয়।

পাস্তা যুদ্ধ

১৯৮৫ সালে ইউরোপ থেকে পাস্তা আমদানিতে শুল্ক বসান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সাইট্রাসজাতীয় পণ্যের ওপর বৈষম্য করা হচ্ছে এমন অভিযোগ আনেন তিনি। প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের লেবু ও আখরোটের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে। ১৯৮৬ সালের আগস্টে এক চুক্তির মাধ্যমে সাইট্রাস বিরোধ মেটানো হয়। পরের বছর পাস্তা বিরোধেরও নিষ্পত্তি হয়।

কলা যুদ্ধ

আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের আমদানি সীমাবদ্ধ করতে ১৯৯৩ সালে লাতিন আমেরিকা থেকে কলা আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বসায় ইউরোপ। ওই সময় লাতিন আমেরিকার কলার খামারগুলোর মূল মালিক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি। তাই এর বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আটটি পৃথক অভিযোগে মামলা করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালে এসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ধীরে ধীরে কলার ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে সম্মত হয়। পরে ২০১২ সালে ইইউ এবং লাতিন আমেরিকার ১০টি দেশ ডব্লিউটিওর ওই আটটি মামলার নিষ্পত্তি করতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। অর্থাৎ ২০ বছর পর নিষ্পত্তি হয় ওই বাণিজ্যযুদ্ধের।