রাতের আলো দিয়ে যায় চেনা

২০১৩ সালের আলোকোজ্জ্বল এশিয়া। ১৯৯২ সালে একই জায়গার তোলা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছবি নাসার।
২০১৩ সালের আলোকোজ্জ্বল এশিয়া। ১৯৯২ সালে একই জায়গার তোলা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছবি নাসার।

দেশের অর্থনীতি কেমন যাচ্ছে তা সাধারণত প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে বিবেচনা করা হয়। আবার এর সঙ্গে অনেক অর্থনীতিবিদ মানব উন্নয়ন সূচকও যুক্ত করতে চান। কিন্তু রাতের বেলা একটি দেশে কত আলো জ্বলে তা দিয়েও যে অর্থনীতির হাল হকিকত বোঝা যেতে পারে, সেটা হয়তো অনেকেরই ভাবনার বাইরে থেকে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি গবেষণাপত্রে সম্প্রতি এই অর্থনৈতিক উন্নয়নে আলোর ভূমিকায় আলোকপাত করা হয়েছে। এতে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা ৩০ বছর ধরে নিশুতি আলোর স্যাটেলাইট ছবি দিয়ে মানবীয় তৎপরতা বোঝার চেষ্টা করছেন। এরপর এক দশক ধরে অর্থনীতিবিদেরা সেই পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ রাতের বেলা একটি দেশে কত বাতি জ্বলছে তা দিয়ে সেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ও অসমতার হার বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁরা। এতে একটা সুবিধা হয়েছে। তা হলো যেসব দেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা কঠিন, অর্থাৎ যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত দেশগুলোর, সেই দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতাও এই নিশুতি আলো দিয়ে পরিমাপ করা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা রসিকতা করে বলছেন, ভিন গ্রহে প্রাণীদের অস্তিত্ব যদি সত্যিই থাকে এবং তাদের পৃথিবীতে আসার ইচ্ছা হয়, তাহলে তারা এই নিশুতি আলোর সাহায্যে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে পারবে। 

রাতের আলো দিয়ে দুটি জিনিস বোঝা যায়। প্রথমত, রাতের বেলা যত এলাকাজুড়ে আলো জ্বলে তা দিয়ে বোঝা যায় যে সেই দেশের অর্থনীতির স্থানিক সম্প্রসারণ কতটা ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, এর উল্টোটাও ঘটে, অর্থাৎ সেই অর্থনীতির কতটা সংকোচন ঘটেছে। তবে সাধারণত ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে দীর্ঘ অঞ্চলজুড়ে আলো দেখা যায়। 

আইএমএফের আফ্রিকা অঞ্চলের অর্থনীতিবিদ জিয়াজিওঙ ইয়াও এক সমীক্ষায় দেখেছেন, ধনী দেশগুলোর রাত স্বল্পোন্নত দেশের রাতের তুলনায় অধিক উজ্জ্বল। তবে এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম আছে। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে নরডিক দেশগুলোর রাত সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি জাপানের বেলায় ব্যাপারটা ঠিক এ রকম নয়। এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বড় হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা হলো রাতের জাপান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার চেয়ে খুব বেশি আলোকোজ্জ্বল থাকে না। মূলত জাপানের মানুষের জ্বালানি ব্যবহারের ধরন ও উচ্চ জন ঘনত্বের কারণে সেখানে রাতের বেলা খুব বেশি মানুষ চলাফেরা করে না। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো জিয়াজিওঙ ইয়াও দেখিয়েছেন, উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে রাতের বেলা বেশি আলো জ্বলে। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশে সব সময় অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলতেই থাকে। অর্থাৎ রাস্তাঘাট, সেতু, রেলস্টেশন, টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো এসব নির্মাণ চলতেই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এসব স্থাপনায় রাতের বেলা আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। স্যাটেলাইট বা ভূ-উপগ্রহ থেকে যখন ছবি তোলা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই এসব দেশ বেশি আলোকিত দেখায়। অন্যদিকে উন্নত অর্থনীতির দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া হয় না। এসব দেশ মূলত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বেশি জোর দেয়। তাই রাতের বেলা সেখানে বেশি আলো জ্বলে না। জিয়াজিওঙ ইয়াও বলছেন, উন্নত অর্থনীতিতে রাতের আলো প্রবৃদ্ধির হার দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হারের অর্ধেক। সে জন্য রাতের চীন ও ভারত যতটা আলোকিত, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ ততটা নয়। গবেষণায় ১৯৯২ সালের এশিয়া এবং ২০১৩ সালের এশিয়ার রাতের স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে রাতের এশিয়া অনেক বেশি উজ্জ্বল। 

তবে যেসব দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন, সেসব দেশের অর্থনীতি পরিমাপে এই পদ্ধতি বেশ কাজের বলেই মনে করছেন গবেষকেরা। এর সঙ্গে এখন বিগ ডেটার যুগ। তথ্যের যে সাগর সৃষ্টি হয়েছে, তা দিয়ে দেশ ও অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক ভালো ধারণা পাওয়া সম্ভব।