ফেলে দেওয়া চুলও রপ্তানি হয়

বাংলাদেশে তৈরি পরচুলা
বাংলাদেশে তৈরি পরচুলা

‘তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো, সেখানেই আমার শরীর।/ তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই/ খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে; আমি এসে পাতি হাত,...’

মাথার চুল নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ এ কবিতা লিখেছিলেন। তবে কেটে ফেলা মাথার চুল নিয়ে কোনো কবিতা আছে বলে শোনা যায় না; যদিও এ চুলের ব্যবসা আছে ঠিকই। কেটে ফেলা চুল এখন দেশের বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক চুলের চেয়ে কৃত্রিম চুলের বাজারই বড়। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের কৃত্রিম চুল ও মানুষের মাথার চুল রপ্তানি হয়েছে। ১ ডলার ৮৫ টাকা করে হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ৪১ শতাংশ।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নারীরা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর যে চুল পড়ে, তা ফেলে না দিয়ে গুছিয়ে রাখেন বিক্রির জন্য। গ্রামের ফেরিওয়ালারা মাসে একবার সেই চুল কিনে নিয়ে যান। চুলের বিনিময়ে চুড়ি, শাড়ি, হাঁড়িপাতিলও বদল হয়।

অনেক সময় গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লাতেও হাঁক দিয়ে চুল কিনতে দেখা যায় একশ্রেণির ফেরিওয়ালাকে। এসব চুল দিয়ে তৈরি হচ্ছে একধরনের পরচুলা। এটি বড় হতে থাকে মূলত ১৯৯৯-২০০০ সালের পর থেকে। চুল ব্যবসায়ীরা জানান, কেটে ফেলা চুল প্রতি কেজি ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। তবে শর্ত হচ্ছে, চুলের আকার একটু বড় হতে হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের গ্লোবাল আউটলুক ও ফোরকাস্ট বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যে পরচুলার বৈশ্বিক বাজার হবে ১ হাজার কোটি ডলারের, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮৫ হাজার কোটি টাকা।

এক কেজি চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ৬০০ গ্রাম হয়। বাংলাদেশ থেকে দুই রকমের চুল রপ্তানি হয় এবং মান নির্ণয় করা হয় চুলের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী। জানা গেছে, প্রতি কেজি চুলের দাম ৭ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

দেশেও চাহিদা বাড়ছে

সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় চুল বেচাকেনার দোকান রয়েছে বলে জানা গেছে। নওগাঁয় সাপ্তাহিক হাটও বসে। যোগাযোগ করলে পারসোনার কর্ণধার কানিজ আলমাস খান প্রথম আলোকে বলেন, দিন বদলেছে। এখন এটা ফ্যাশনের অংশ। আগে মাথায় চুল না থাকা বা কম থাকা ব্যক্তিরা পরচুলা ব্যবহার করলেও এখন চেহারায় অন্য রকম ভাব আনার (লুক চেঞ্জ) জন্যও ব্যবহার করছেন। চাহিদা বাড়ছে বলে দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।

রপ্তানিমুখী চারটি কারখানা
দেশে চারটি পরচুলা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার তিনটিই ইপিজেডে এবং তিনটির মালিকানাই চীনাদের। এর মধ্যে উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস, ঈশ্বরদীতে এমজেএল কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ও মোংলায় রয়েছে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি। ইপিজেডগুলো চলে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতায়। এর বাইরে গাজীপুরেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বেপজার মহাব্যবস্থাপক নাজমা বিনতে আলমগীর জানান, ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে, পরচুলার রপ্তানি প্রতিবছরই বাড়ছে। তবে ইপিজেডের কারখানার মালিকেরা কেউ এ বিষয়ে বিশদ কিছু জানাতে চান না। তাই কিছু বলতে চান না তিনিও।