আধা পচা পেঁয়াজ, তবু কেজি ৭০ টাকা

রফিক হোসেন ও তাঁর স্ত্রী বঁটি দিয়ে পেঁয়াজ কাটায় ব্যস্ত। কুচি কুচি করে নয়, কাজ মূলত আধা পচা পেঁয়াজের ওপরের খোসা ছাড়িয়ে নেওয়া, পচা অংশ কেটে রোদে রাখা; যাতে বিক্রির উপযোগী হয়। 

অন্য সময় এসব পেঁয়াজ বাজারে বিকোত না, স্থান হতো ভাগাড়ে। কিন্তু এখন পেঁয়াজ বড় দামি। আধা পচা হলেও সেটা কেজিপ্রতি ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 

রফিক হোসেন বললেন, কারওয়ান বাজার থেকে প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে তিনি কয়েক বস্তা পেঁয়াজ কিনেছেন। সেখান থেকে বাছাই করে কেটেকুটে যা বিক্রির উপযোগী, তা ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। 

এই পেঁয়াজের ক্রেতা কারা, জানতে চাইলে পাশের দোকানদার মো. রতন বললেন, শুধু বস্তিবাসী নন, ফ্ল্যাটবাসীও সেগুলো কেনেন। আরেক পাশ থেকে চায়ের দোকানি সাথী বেগম বললেন, ‘কয় জনে ১০০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে পারে, বলেন।’ 

পচা পেঁয়াজের এই কেনাবেচা হচ্ছে বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও যেতে ফ্লাইওভারের নিচের বাজারে। শুধু ওই বাজারে নয়, দাগযুক্ত পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, পশ্চিম আগারগাঁও, কাজীপাড়া প্রভৃতি এলাকায়ও, কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। আর ভালো মানের দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকা। 

সম্প্রতি মিয়ানমার ও ভারতীয় পেঁয়াজের কিছু চালান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজ তাঁরা ফেলে দিয়েছেন। আর আধা পচা পেঁয়াজ ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। 

দিনে একটি! 

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এই সময় বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৫০ টাকা। এর মানে মানুষকে এখন দ্বিগুণ থেকে চার গুণ দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। 

পীরেরবাগের মরিয়ম বেগম ২৫ টাকায় আড়াই শ গ্রাম পেঁয়াজ কিনে ফিরছিলেন। ভারতীয় ওই পেঁয়াজ আকারে বড়। সংখ্যায় দাঁড়ায় পাঁচটি। একেকটির দাম পড়ে ৫ টাকা। জানতে চাইলাম কত দিন চলবে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আগে দুদিন যেত। এখন চার দিন চালাতে হবে। এক দিনে এখন আর একটার বেশি খরচ করি না।’ 

হাবিব হোটেল মিরপুরের ৬০ ফুট সড়কে। শিঙারা, সমুচার মতো হালকা খাবার বিক্রি হয়। জানতে চাইলাম, শিঙাড়ার সঙ্গে পেঁয়াজ নেই? মালিক উত্তর দিলেন, পেঁয়াজ চাওয়া এখন অন্যায়। কেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি দাম কতটা চড়া, তা শুনিয়ে দিলেন। 

পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা থামছে না কিছুতেই। আবারও সেঞ্চুরি ছাড়িয়েছে এর দাম। এদিকে মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। তাই কিছুটা ফেলে দিতে হচ্ছে,আর বাকিটা বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। গতকাল পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায়।  ছবি: হাসান রাজা
পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা থামছে না কিছুতেই। আবারও সেঞ্চুরি ছাড়িয়েছে এর দাম। এদিকে মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। তাই কিছুটা ফেলে দিতে হচ্ছে,আর বাকিটা বিক্রি হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। গতকাল পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায়। ছবি: হাসান রাজা

দুই মাসে দেড় লাখ টন

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের প্রথম দিন থেকে গত ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে দেড় লাখ টন আমদানি করা পেঁয়াজ ঢুকেছে। এর মধ্যে আগস্টে ঢুকেছে ৬৭ হাজার ৭৩৭ টন। সেপ্টেম্বরে এসেছে ৭৬ হাজার ২৭৭ টন। অন্যদিকে চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৪২৭ টন পেঁয়াজ। 

পেঁয়াজের গড় আমদানি মূল্যেও বড় ধরনের ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের চার সপ্তাহে টনপ্রতি ১৯০ থেকে ৩১৪ মার্কিন ডলার দরে পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়। কেজি পড়ে ১৬ থেকে ২৭ টাকা। 

সেপ্টেম্বর মাসের চার সপ্তাহে টনপ্রতি ২৪৬ থেকে ৫৯৫ ডলারে পেঁয়াজের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়। এতে দাম পড়ে ২১ থেকে ৫১ টাকা। আর সর্বশেষ এ মাসের প্রথম পাঁচ দিনে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে গড়ে টনপ্রতি ৬২৩ ডলার দরে, কেজিপ্রতি দর ৫৩ টাকা। এ দামের সঙ্গে জাহাজভাড়া ও অন্যান্য খরচ যুক্ত হবে। 

কিন্তু পাইকারি বাজারে যেকোনো পেঁয়াজ (পচন না ধরা) ৭২ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিকোচ্ছে। 

তুরস্কের পেঁয়াজ ৪০ টাকা 

পেঁয়াজের বাজার সামাল দিতে মেঘনা ও সিটির মতো বড়দের মাঠে নামিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সিটি গ্রুপ জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যে তুরস্ক থেকে আড়াই হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খুলেছে। এ পেঁয়াজ দেশে আসবে চলতি মাসের শেষ দিকে। প্রতি কেজির আমদানি মূল্য পড়বে ৪০ টাকার মতো। এর আগে আরও কিছু পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করছে সিটি। 

সিটির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমরা এই পেঁয়াজ আনছি। এখানে ব্যবসা করা উদ্দেশ্য নয়।’ 

এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আজ বুধবার একটি বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘ছোট, বড়, মাঝারি—সব ব্যবসায়ীকে বৈঠকে ডাকা হয়েছে।’