জিপি-রবিতে প্রশাসক বসাতে সরকারের সায়

দুই শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি আজিয়াটার কাছ থেকে পাওনা আদায়ে প্রশাসক বসানোর সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে সরকার। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) প্রশাসক বসানোর অনুমোদন দিয়েছে।

এর মাধ্যমে দুই অপারেটরের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা কার্যত ব্যর্থ হলো। এদিকে গ্রামীণফোনের এক আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট পাওনা আদায়–সংক্রান্ত পদক্ষেপের ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অবশ্য রবির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

সরকার গ্রামীণফোন ও রবিতে প্রশাসক বসালে সেটি হবে নজিরবিহীন ঘটনা। জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামীণফোন নিম্ন আদালতে মামলা করে হেরে গিয়ে উচ্চ আদালতে গিয়েছে। আমরা সেটা জেনেছি। আদালতেই বিষয়টি মোকাবিলা করা হবে। প্রশাসক বসানোর প্রস্তুতি বসে থাকবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনুমোদন দিয়েছি, তার মানে এই নয় যে কালকেই প্রশাসক বসবে। এটি আমরা প্রথমবারের মতো করছি। অভিজ্ঞতা নেই। একটু সময় লাগবে।’

বিটিআরসির দাবি অনুযায়ী, রাজস্বের ভাগাভাগি, কর ও অন্যান্য খাতে গ্রামীণফোন ও রবির কাছে
প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি টাকা। এ পাওনার উৎস গ্রামীণফোনের ওপর ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এবং রবির ওপর ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষা। অবশ্য গ্রামীণফোন ও রবি সব সময় বলে আসছে, তাদের যুক্তি নিরীক্ষায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

বিটিআরসি চিঠি দিয়ে পাওনা না পেয়ে দুই অপারেটরের ব্যান্ডউইডথ সীমিত করা এবং প্যাকেজ ও সরঞ্জামের ছাড়পত্র (এনওসি) দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় ৫ সেপ্টেম্বর দুই অপারেটরকে লাইসেন্স (টু-জি ও থ্রি-জি) বাতিল কেন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। জবাবের সময় ছিল ৩০ দিন। বিটিআরসি বলছে, তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর দৃশ্যপটে আসেন অর্থমন্ত্রী। তিনি টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাইকেল ফোলিকে নিয়ে একটি বৈঠক করে বলেন, খুব শিগগির আলোচনার মাধ্যমে এর সুরাহা হবে। এরপর দুই দফা বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ বৈঠক হয় ৩ অক্টোবর।

>

সব আলোচনা ব্যর্থ
সরকার এখন কঠোর অবস্থানে
আদালত থেকে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে গ্রামীণফোন

৩ অক্টোবরের বৈঠকের কার্যবিবরণীর একটি কপি প্রথম আলোর হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সভায় পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। যা হলো: ১. দুই পক্ষ একটি কমিটি গঠন করে পাওনা পরীক্ষা অথবা পরীক্ষার পদ্ধতি বের করবে। ২. বিটিআরসি লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। অন্যদিকে অপারেটররা মামলা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেবে। ৩. অর্থমন্ত্রী, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, এনবিআর ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখবেন। ৪. কমিটি গঠন ও কমিটির কাজ শুরুর আগে আগামী সাত দিনের মধ্যে গ্রামীণফোন ১০০ কোটি ও পরের এক মাসের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বিটিআরসিকে দেবে। রবি দেবে দুই দফায় ৫০ কোটি টাকা। ৫. এসব প্রস্তাব দুই অপারেটর তাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যালোচনা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করবে।

জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, তাদের বলা হয়েছিল, কিছু টাকা দাও। তারা সেই নির্দেশ পালন করেনি। রবি নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম টাকা নিয়ে এসেছিল, তা গ্রহণ করা হয়নি। মন্ত্রী আরও বলেন, গ্রামীণফোন সাত দিনের মধ্যে পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন নিয়ে টাকা জমা দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু টাকা দেয়নি। তিনি বলেন, ‘তারা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। আর কত ছাড় দেওয়া যায়।’

অবশ্য অপারেটর দুটির কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলছেন, বিটিআরসি কমিটি গঠন বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো কাজই শুরু করেনি।

নিষেধাজ্ঞা

বিটিআরসি লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার আগেই আগস্টের শেষ সপ্তাহে গ্রামীণফোন ও রবি পাওনা আদায়ের পদক্ষেপে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে নিম্ন আদালতে যায়। ২৮ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালত গ্রামীণফোনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায় গ্রামীণফোন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি এ কে এম আবদুল হাকিম ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পাওনা আদায়–সংক্রান্ত পদক্ষেপের ওপর দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন বলে জানিয়েছে গ্রামীণফোন ও আইনজীবী সূত্র। আদালত একটি রুলও দিয়েছেন। একই সঙ্গে আগামী ৫ নভেম্বর আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

আদালতে গ্রামীণফোনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন, আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া ও তানিম হোসেইন। বিটিআরসির পক্ষে লড়তে আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই রাকিব আদালতে ওকালতনামা জমা দেন।

গ্রামীণফোনের হেড অব রেগুলেটরি ও অ্যাক্টিং হেড অব কমিউনিকেশন হোসেন সাদাত এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেন, ‘বিটিআরসির বিরোধপূর্ণ নিরীক্ষা দাবিটির বিপরীতে একটি স্বচ্ছ সমাধানে পৌঁছাতে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বিষয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতিটি পুনর্ব্যক্ত করতে চাই।’ তিনি জানান, গ্রামীণফোনের ওপর আরোপিত বিরোধপূর্ণ নিরীক্ষা দাবিটির পাওনা আদায়ে বিটিআরসির যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর হাইকোর্ট বিভাগ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার আমদানি, নতুন সেবা ও প্যাকেজ ঘোষণার ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র প্রদান স্থগিত করে বিটিআরসির দেওয়া চিঠিটির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে আদালতের পক্ষ থেকে।

‘তাহলে সেই বিনিয়োগ দরকার নেই’

মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণফোন ও রবির ওপর আদালতের রায় অনুযায়ী নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এরপর যে পাওনা দাঁড়িয়েছে, সেটা উদ্ধারেই এই পদক্ষেপ। তিনি বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ থাকতে পারে না, যারা জাতীয় রাজস্ব আদায়ে বিরত থাকবে। এটা জনগণের অর্থ। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই। বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতো, যদি তাদের সঙ্গে কোনো অন্যায় করা হতো, অবিচার করা হতো, যদি বেআইনি কিছু করা হতো। পাওনা আদায়ের জন্য যদি বিনিয়োগ না আসে, তাহলে সেই বিনিয়োগ দরকার নেই।

তবে প্রশাসক বসানোর উদ্যোগ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভুল সংকেত পাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রশাসক বসানোর উদ্যোগের বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সব বিনিয়োগকারী মনে করে, আরবিট্রেশন বা সালিসের সুযোগ পাওয়া তাদের মৌলিক অধিকার। গ্রামীণফোন ও রবিকে সেটার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা আলোচনা, সালিস নয়।