বাংলাদেশ-ভারতের ব্যবসার কেন্দ্রস্থল হতে পারে সিলেট

মোহাম্মদ শোয়েব, সভাপতি  সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
মোহাম্মদ শোয়েব, সভাপতি সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
>

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব। গত ২১ সেপ্টেম্বর নির্বাচনে সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ প্যানেল থেকে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর রয়েছে হোটেল, শেয়ারবাজার, ইলেকট্রনিকসের ব্যবসা। চেম্বারের নবনির্বাচিত এই সভাপতি সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটনশিল্পসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উজ্জ্বল মেহেদী। 

প্রথম আলো: চেম্বারের নেতৃত্ব নির্বাচনে দুটি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আপনার নেতৃত্বাধীন প্যানেল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচন নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব: একটি সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হওয়ায় আমাদের নিয়ে ব্যবসায়ী মহলের পাশাপাশি সিলেটের সব মহলে বড় ধরনের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ব্যবসায়ী মহল সন্তুষ্ট। এখন আমাদের সামনে প্রত্যাশা পূরণের বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের আগে আমরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আগে সেগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেব। পাশাপাশি অন্য কাজগুলোও করব।

প্রথম আলো: সাধারণ ভোটারের সমর্থন পেতে আপনারা কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন?

মোহাম্মদ শোয়েব: সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের জন্য সর্বদলীয় একটা রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সব ব্যবসায়ীর চাওয়া ছিল। আমরা সম্মিলিত পরিষদ থেকে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব ব্যবসায়ীকে আশ্বস্ত করেছিলাম। আমাদের আশ্বাসে ভরসা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে পর্যটন খাত নিয়ে আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। সিলেটে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে ট্যুরিস্ট বাসসেবা। আমাদের আরেকটি প্রতিশ্রুতি ছিল সিলেট চেম্বারের নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে না রাখার। অতীতে ভোটের সময় মামলা-মোকদ্দমা দেখিয়ে নির্বাচন বন্ধ রাখার একটি হীন প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। এবার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। চেম্বারের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে না রাখা আমাদের বড় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল।

প্রথম আলো: সিলেটের পর্যটন খাত নিয়ে ভাবনা কী?

মোহাম্মদ শোয়েব: সিলেটের পর্যটন বলতে মূলত প্রাকৃতিক স্থান। মাধবকুণ্ড, জাফলং, রাতারগুল, লালাখাল, সারি নদী, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর আর হাওর। সিলেটের বেসরকারি লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যটন নিয়ে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। ফলে পর্যটন বিষয়ে শিক্ষিত একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে এ এলাকায়। এখন দরকার পর্যটকদের আগ্রহ ও চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। পর্যটন স্থানগুলো ঘিরে হোটেল-রেস্তোরাঁ হচ্ছে। বিলাসবহুল রিসোর্ট হচ্ছে। পাহাড়-টিলাকেন্দ্রিক এসব রিসোর্ট একেকটি এলাকার চেহারা বদলে দিচ্ছে। এখন দরকার সিলেটকে পর্যটনের নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উন্নয়ন।

প্রথম আলো: সিলেটে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান সমস্যা ও সম্ভাবনা কী?

মোহাম্মদ শোয়েব: বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সিলেটে বড় কোনো শিল্প, কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। হবিগঞ্জ এলাকায় কিছু কলকারখানা হয়েছে, কিন্তু সিলেট নগরী বা তার আশপাশে তেমন কোনো শিল্পকারখানা নেই। অথচ এখানে রয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ। গ্যাস, পাথর, বালু সিলেট অঞ্চল থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। হাওর থেকে উৎপাদিত মাছ যাচ্ছে দেশের বাইরেও। প্রাকৃতিক সম্পদের এই সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সিলেট থেকে খুব সহজেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে পণ্য রপ্তানি সম্ভব। ফলে সিলেট বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রস্থল হতে পারে। এ জন্য তামাবিল ও সুতারকান্দি স্থলবন্দরের আধুনিকায়ন দরকার।

প্রথম আলো: সিলেটে বড় শিল্পকারখানা হচ্ছে না কেন?

মোহাম্মদ শোয়েব: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর নানা দেশে সিলেটের বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন। বিদেশে তাঁদের বড় বড় ব্যবসা ও বিনিয়োগ আছে, কিন্তু তাঁরা দেশে কিছু করছেন না। দেশে আসেন শুধু বেড়াতে। প্রবাসীদের সিলেটে বিনিয়োগমুখী করতে পারলে বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠত। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, কোম্পানীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক হলে প্রবাসীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। বর্তমান সরকারের আমলে সিলেটে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার মধ্যে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক, শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র, তামাবিলে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্যোগের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে তরুণ ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার পাশাপাশি প্রবাসী বিনিয়োগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

প্রথম আলো: মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব নিয়ে কি কোনো আলোচনা হয়েছে?

মোহাম্মদ শোয়েব: সিলেট চেম্বারের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের স্থানীয় সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে আমরা বিভিন্ন সমস্যা ও দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরেছি। চেম্বারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটে ১০০ একর জমি নিয়ে মাল্টি সেক্টরাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে। সেটি হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প যেমন সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি আমদানি–নির্ভরতা কমিয়ে পণ্য উৎপাদন বাড়বে।
তখন এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য ভারতের সাত রাজ্যসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা যাবে। আপনি দেখবেন, তামাবিল হয়ে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে যাতায়াত আছে আমাদের ও ভারতীয় নাগরিকদের। কিন্তু তামাবিল পার হয়ে ওপারে গেলে রাস্তাঘাট, অবকাঠামো এক রকম আর আমাদের আরেক রকম। এই দৈন্য ঘুচাতে সমন্বিত উন্নয়ন চাই। এসব বিষয় আমরা মন্ত্রীকে অবহিত করেছি।

প্রথম আলো: আমরা বিভিন্ন সময় দেখি, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে চেম্বারের পক্ষ থেকে বাজার তদারকির কোনো উদ্যোগ আপনারা নেবেন কি?

মোহাম্মদ শোয়েব: দেখুন, এ ধরনের সমস্যা বহু পুরোনো। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটতে একটি চক্র সব সময়ই সক্রিয় থাকে। আমরা সিলেটে এ ধরনের চক্র ভাঙার চেষ্টা করব। আমদানি ও রপ্তানির তারতম্যে দ্রব্যমূল্যে ওঠানামা থাকবেই। তবে ভোক্তার কথা চিন্তা করে এ দাম সহনশীল পর্যায়ে রাখতে হবে। আবার ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সিলেট চেম্বারের পক্ষ থেকে বাজার তদারকির জন্য একটি উপকমিটি সব সময় সক্রিয় রাখব। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিলেট চেম্বার প্রতি সপ্তাহে নিত্যপণ্যের দর প্রকাশ করবে। এতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের মজুত দেখিয়ে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে সরে আসবেন আর ভোক্তারাও বাজারদর সম্পর্কে অবহিত থাকবেন।