কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াচ্ছে শরীফের প্রোট্র্যাকার

নিজের প্রতিষ্ঠানে বি এম শরীফ। ছবি: আশরাফুল আলম
নিজের প্রতিষ্ঠানে বি এম শরীফ। ছবি: আশরাফুল আলম

দিন শেষে যদি দেখা যায় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হয় না, তখনই টের পাওয়া যায় ম্যানুয়াল পদ্ধতির বিপদ। বস্ত্রশিল্পে এটি খুবই ক্রান্তীয় সমস্যা, কারণ এখানে প্রতি মুহূর্তের হিসাবটা জরুরি। কিন্তু এখনো আমাদের বেশির ভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় সার্বক্ষণিকভাবে উৎপাদন পর্যবেক্ষণ বা ট্র্যাক করা হয় না। একই সঙ্গে হাতে হাতে হিসাব করার কারণে ভুলভ্রান্তিসহ কর্মীদের দক্ষতাও আশানুরূপ হয় না।

পোশাকশিল্পে কাজ করার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের স্নাতক বি এম শরীফ ভেবেছেন কী করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। ‘আমার মনে হয়েছে, কাপড় কাটা থেকে শুরু করে পোশাক প্রস্তুত করে তা কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় পর্যন্ত পুরোটা যদি সহজভাবে ট্র্যাক করা যায়, তাহলে তা একদিকে সাশ্রয়ী হবে এবং অন্যদিকে কর্মীদের দক্ষতাও বাড়াবে’—মিরপুরে নিজের অফিস বসে বলছিলেন শরীফ। ‘তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যবস্থাটা যেন সহজ হয়, পোশাকশিল্পের কর্মীরা যেন সহজেই সেটা ব্যবহার করতে পারেন।’ আর এই চিন্তার ফসল হলো পোশাকশিল্পের জন্য বিশেষায়িত সফটওয়্যার ‘প্রোট্র্যাকার’।

প্রোট্র্যাকার একটি বারকোডভিত্তিক উৎপাদন ট্র্যাকিংয়ের সফটওয়্যার, যা পোশাক কারখানার ‘কাটিং’ থেকে ‘ফিনিশিং’-এর সব স্তরে কাজ করে। এ ব্যবস্থা থেকে কেবল ‘বান্ডেল কার্ড’ই নয়, বরং ‘সেকশন টু সেকশন’ চালান পত্র, ‘ইনপুট’ তথ্য—সবই বের হয়। এ ছাড়া কারখানায় একটি বড় টেলিভিশন পর্দায় সব স্তরের কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে দেখানো হয়। ‘এর ফলে আমরা যেকোনো সময় বুঝতে পারি কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হচ্ছে কি না, কোথাও কাজের গতি মন্থর হচ্ছে কি না’—জানালেন মণ্ডল গ্রুপের পরিকল্পনা ও উৎপাদনের উপমহাব্যবস্থাপক আসাদুজ্জমান আসাদ। মণ্ডল গ্রুপের দুটি কারখানায় প্রোট্র্যাকার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তৃতীয় একটিতে এখন সেটি বাস্তবায়নাধীন। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি স্বয়ংক্রিয় বলে ব্যবহারকারীদের কেবল বারকোড স্ক্যানার ব্যবহার করতে হয়। আসাদুজ্জামানের বক্তব্য, এর ফলে কর্মীরা সহজে এটি ব্যবহার করতে পারেন।

তবে কেবল কর্মীদের জন্য নয়, একই সঙ্গে এটি ব্যবস্থাপকদেরও সুবিধা দেয়। ক্লাউডভিত্তিক হওয়ায় ব্যবস্থাপকেরা পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে কারখানার উৎপাদন সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। গত তিন বছরে প্রায় ৫০টির মতো কারখানায় শরীফের প্রোট্র্যাকার বাস্তবায়িত হয়েছে।

তবে বি এম শরীফ কেবল উৎপাদন ট্র্যাক করেই থেমে থাকতে চাননি। তিনি জানালেন, ‘বিশেষ করে এ রকম শিল্পের জন্য বিদেশি ইআরপির দাম অনেক বেশি। অনেকে ইচ্ছে থাকলেও সেটি ব্যবহার করতে পারেন না। আবার আমাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী সেগুলো তৈরি হয় না। কাজে কাস্টোমাইজেশনেও প্রচুর সমস্যা হয়ে থাকে।’ এ চিন্তা থেকেই শরীফের প্রতিষ্ঠান স্কাইলার্ক সফট লিমিটেড তৈরি করেছে গোআরএমজি (goRMG) নামে পোশাকশিল্পের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার। এতে মার্চেন্ডাইজিং, কমার্শিয়াল, প্রকিউরমেন্ট, ইনভেনটরি, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স, কাটিং, ওয়াশিং, ডায়িং, ফিনিশিং, নিটিংয়ের মতো প্রয়োজনীয় সব ফিচার ছাড়াও আইই, বাজেট, প্ল্যানিং, টাইম অ্যান্ড অ্যাকশনের মতো জটিল কার্যক্রমগুলো অনায়াসেই সম্পন্ন করা যায়। এ ছাড়া তাদের আরেকটি সফটওয়্যার হলো নিটট্র্যাকার, যা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাপড়ের হিসাব করা হয়।

বি এম শরীফ
বি এম শরীফ

রাজশাহীতে পড়ার সময় থেকে স্কাইলার্ক সফট লিমিটেড নামে নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করেন বি এম শরীফ, আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। ২০১২ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে কয়েক বছর বিভিন্ন গার্মেন্টসে চাকরি করেছেন। ২০১৬ সাল থেকে নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রায় ৪০ জনের বেশি একটি কর্মী দলকে পরিচালনা করছেন। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে অ্যাডভান্সড সার্টিফিকেশন ফর ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনালস এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিজিটাল বিজনেস অ্যান্ড ইনোভেশন লিডারশিপ প্রোগ্রামটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে যে খাত থেকে, সে খাতের কারিগরি সমস্যা সমাধানে মেধাবীদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এই তরুণ সফটওয়্যার নির্মাতা। তাঁর ধারণা, দেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন উদ্ভাবনের এক চমৎকার আবহ গড়ে তোলা সম্ভব। এ জন্য উদ্ভাবনকে শিল্পে নিয়ে যাওয়া দরকার। দেশীয় উদ্ভাবকদের সুযোগ দিলে তারা তৈরি দেশীয় পোশাকশিল্পের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমিয়ে সেটিকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে সহায়তা করবে বলে তিনি মনে করেন। ভবিষ্যতেও এই খাতে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে বি এম শরীফের।

চিকিৎসক স্ত্রী রেহানা আক্তার ও দুই বছর বয়সী ছেলে রাদিয়ান বিন শরীফকে নিয়ে মিরপুরেই থাকেন এ উদ্যোক্তা। সময় পেলেই বই পড়তে ভালোবাসেন।