তত্ত্ব নয়, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নোবেল বিজয়

নোবেল পাওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে অভিজিৎ ব্যানার্জি
নোবেল পাওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে অভিজিৎ ব্যানার্জি

ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে দান করে থাকে। কিন্তু এই দান কাজে লাগে কি লাগে না, তার ফিরিস্তি লিখতে অর্থনীতিবিদেরা দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ব্যয় করেছেন। বড় পরিসরে বিবেচনা করলে অনুদান নিয়ে বিতর্কের দুটি ধারা স্পষ্ট। একদিকে আছে বামেরা, অন্যদিকে ডানেরা। কিন্তু এই দুই বিপরীত মেরুর বাইরেও যে একটা পথ থাকতে পারে তা দেখালেন এবার অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। অনুদান কোন পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে কাজে লাগে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন তাঁরা।

তাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করার জন্য। ফলে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, দারিদ্র্য বিমোচনে কী তত্ত্ব দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তিনজনের কেউই বস্তুত দারিদ্র্য বিমোচনের নতুন তত্ত্ব দেননি। বিশেষ পথও বাতলে দেননি। বরং, তাঁরা উন্নয়ন অর্থনীতিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করার বিদ্যায়তনিক মনোভঙ্গির কথা বলেছেন এবং নিজেরাও গত দুই দশক ধরে সেই আলোকে গবেষণা করেছেন। পৃথিবীজুড়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এই ধারাটিকে জনপ্রিয় করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা। দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসি সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

দারিদ্র্য ও অনুদান
বামেদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকসের কথাই বলা যায়। তাঁর মতে, গরিব মানুষেরা প্রধানত যে কারণে গরিব, তা আর কিছু নয়—দারিদ্র্য। বিদেশি দান-অনুদান যদি তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে পারত, তাহলে তারা বেশ দ্রুতই নিজেদের সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারত। অন্যদিকে ডান পক্ষের উইলিয়াম ইস্টার্লির বক্তব্য হচ্ছে, মূল সমস্যা দারিদ্র্য নয়, দান নিজেই। এই ঘরানার লোকেরা মনে করেন যে দান নির্ভরশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করে। এতে গরিবেরা গরিবই থেকে যায় এবং মুক্তির একমাত্র পথে সওয়ার হতে পারে না। সেই পথটা হলো মুক্তবাজার।

কিন্তু অভিজিৎ ব্যানার্জি মনে করেন, এই উভয় অবস্থানেই যত না বিতর্ক নৈপুণ্য ও অনুমান আছে, ততটা প্রমাণ নেই। গরিব দেশগুলো এযাবৎকাল শত শত কোটি ডলারের দান পেয়েছে। কিন্তু এই দানের ফল কী, তা খুব একটা খতিয়ে দেখা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ২০০৩ সালে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো ২০০৩ সালে আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব তৈরি করে দানের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এ জন্য তাঁরা ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত র্যানডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেন। ২০১০ সালের মধ্যে এই সংস্থার গবেষকেরা ৪০টি দেশে ২৪০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। কাজটা নিতান্ত অল্প ছিল না।

ফলাফল যা পাওয়া গেল, তা বেশ চমকে যাওয়ার মতো। বিনা মূল্যে যাঁরা মশারি থেকে শুরু করে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, বিনা মূল্যে শিক্ষা বা জন্মবিরতির উপকরণ পেয়েছেন, তাঁরা অদ্ভুত কারণে এসব ব্যবহার করতে চান না। ব্যাপারটা ধাঁধার মতো। এমনকি যে ক্ষুদ্রঋণকে দারিদ্র্যমুক্তির মহাসনদ মনে করা হতো, তা-ও অতটা বিপ্লবী নয়। এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতেই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো পুওর ইকোনমিকস লিখে ফেলেন। তবে বইটিতে লেখকদ্বয় ডান ঘরানার অর্থনীতিবিদ ইস্টার্লির সাফাই গাননি। কারণ, তাঁরা দেখেছেন যে দান বিতরণের পদ্ধতিতে সামান্য কিছু অদলবদল আনা গেলে এর কার্যকারিতায় বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা দেখান যে বীজ বপনের সময় কেনিয়ার কৃষকদের অর্ধেক দামে সার দিয়ে কাজের কাজ হয় না। কারণ, তখন তাঁদের কাছে অর্ধেক দামেও সার কেনার মতো টাকা থাকে না। অত টাকা জমিয়ে রাখার ক্ষমতা তাঁদের নেই। কিন্তু ফসল তোলার পর যখন তাঁদের কাছে টাকা থাকে, তখন যদি কৃষকদের কাছে পুরো দামেও সারের ভাউচার বিক্রি করে প্রয়োজনের সময় তার বিপরীতে সার দেওয়া হয়, তাহলে সারের ব্যবহার ৫০ শতাংশ বাড়ে। তাঁরা পরীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন। ব্যাপারটা হলো, স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে যদি দান বিতরণ করা যায়, তাহলে স্যাকসের চাওয়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অর্থাৎ গরিব মানুষেরা কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে চায়, তা বিবেচনা করার কথা বলেছেন এই ত্রয়ী। এটি অর্থনৈতিক গবেষণায় নৃতাত্ত্বিক মাত্রা যুক্ত করেছে।

পুওর ইকোনমিকস বইটির প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘থিঙ্ক অ্যাগেইন, অ্যাগেইন’। এই অধ্যায়ের এক জায়গায় লেখকদ্বয় বলছেন, দান ভালো না মন্দ, তা নিয়ে এই বইয়ে কিছু বলা হয়নি। বরং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে দান কাজে এসেছে কি না, তা বলা হয়েছে। তাঁরা বলছেন যে এ বিষয়ে বড় চিন্তার ব্যাপার নেই। ব্যাপারটা সুনির্দিষ্ট। গণতন্ত্রের সঙ্গে এর তুলনা টেনেছেন তাঁরা। বলছেন, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু মাঠের বাস্তবতার আলোকে গণতন্ত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনে ইন্দোনেশিয়ার গ্রামে তা আরও কার্যকর করা যায় কি না, সেটাই প্রশ্ন।

বড় ক্যানভাস ভেঙে ছোট করা
অভিজিৎ ও দুফলোর সঙ্গে আরেক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমারও এই নোবেল পুরস্কারের ভাগীদার। এই গবেষক ত্রয়ী মূলত দারিদ্র্যকে বড় ক্যানভাসে না দেখে সুনির্দিষ্ট পরিসরে দেখার চেষ্টা করেছেন। কোন পরিস্থিতিতে মানুষ কেমন আচরণ করে, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করেছেন। সমস্যার ধরন বুঝে সমাধানের পথ বাতলানোর চেষ্টা করেছেন। নীতিগত পরামর্শ দিয়েছেন।

দারিদ্র্যর আবার রকমভেদ আছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী দারিদ্র্যের ধরন বদলে যায় এবং সে কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের সর্বজনীন সূত্র বা সমাধান নেই—এটাই তাঁদের মূল প্রত্যয়। ফলে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপরও গবেষণা করেছেন তাঁরা।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো পুওর ইকোনমিকস বইয়ে অবশ্য বলেছেন, দিনে সোয়া এক ডলার বা তার চেয়ে কম আয় করা চরম দরিদ্রদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা খুবই কঠিন। গবেষণায় অবশ্য তাঁরা সেই চেষ্টা করেছেন। তাঁরা দারিদ্র্য বিমোচন বা নিরসনের তাত্ত্বিক উপায় থেকে বেরিয়ে এসে প্রায়োগিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জোর দিয়েছেন।

রাজনীতি ও দুর্নীতি
বিশ্লেষকেরা বলেন, রাজনীতি থেকে অভিজিৎ যোজন যোজন দূরে থাকেন। পুওর ইকোনমিকস-এ লেখকদ্বয় দারিদ্র্যের কারণ নির্ণয়ে প্রচলিত পথ মারাননি। বরং সেই পথ থেকে অনেক দূরে রেখেছেন নিজেদের। সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতিকে তাঁরা দুর্নীতির প্রধান কারণ মনে করেন না। প্রথমে রাজনৈতিক সংস্কার এবং তারপর সব হবে—এই তত্ত্ব অভিজিৎ জরুরি মনে করেন না। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়াও অনুদানের সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব। ফলে অভিযোগ, তিনি ক্ষমতার গুরুত্ব খাটো করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থান হলো: ‘মানুষ আমাকে কিঞ্চিৎ ভুল বুঝছে। রাজনীতির গুরুত্ব নেই—এ কথা আমরা বলিনি। উত্তর কোরিয়ার মানুষের কিছু বলার নেই। দেশটির প্রেসিডেন্ট একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ। ফলে রাজনীতি ওখানে সমস্যা নয়, এমন ভান আমরা ধরি না।’

অভিজিৎ আরও বলেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই রাজনীতির লেজেগোবরে অবস্থা। কিন্তু সেখানকার রাজনীতিকেরাও বোঝেন, তাঁদের রাজনৈতিক বৈধতা দরকার। দুর্নীতিগ্রস্ত হলেই যে রাজনৈতিক বৈধতা লাগবে না, তা নয়। বৈধতা এ কারণে দরকার যে আরও বেশি দুর্নীতি করার জন্য ক্ষমতায় থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে ১৯ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টানেন তিনি। তখন দেশটি আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠে। একই কথা আজকের চীনের বেলায়ও প্রযোজ্য। রাজনীতি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাজে রাজনীতি মানেই সবকিছু শেষ—এটা তিনি মনে করেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পৃথিবীর গত ২০০ বছরের ইতিহাস সে কথা বলে না।

দ্য গার্ডিয়ান একবার অভিজিৎ ব্যানার্জিকে প্রশ্ন করেছিল, দারিদ্র্যকে ইতিহাস বানানোর মতো জনতুষ্টিবাদী স্লোগান সম্পর্কে তিনি কী মনে করেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এই লক্ষ্যটা ভালো। পৃথিবী এখনো অত ধনী হয়নি। এখনো বহু মানুষ ময়লার ভাগাড়ের পাশে বসবাস করে। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্যকে একদম ইতিহাস বানানো যাবে না। কিন্তু চরম ও কুৎসিত দারিদ্র্যের সমাধান আমরা করতে পারি।