নোবেলের মঞ্চে আরেক বাঙালি

>

অর্থনীতিতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয় কেবল বাঙালি বলে সবার দৃষ্টি কেড়েছে তা নয়, তাঁর গবেষণায় জড়িয়ে আছে বাংলাদেশেরও নাম। ব্র্যাকের অতিদারিদ্র্য থেকে উত্তরণের মডেল নিয়েও ছিল তাঁর কাজ। অভিজিৎ নোবেল ভাগাভাগি করেছেন আরও দুজনের সঙ্গে। 

অর্থনীতিবিদদের নিয়ে মজার একটি কথা চালু আছে। আর তা হচ্ছে, দুজন অর্থনীতিবিদ এক হলে তত্ত্ব বের হয় তিনটি। অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এসব হাসি-ঠাট্টা ভুল প্রমাণ করে এবার একসঙ্গে তিনজন অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে গেলেন, তা-ও একই কাজে, ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব না দিয়েই। তাঁদের একজন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য নোবেল পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা বাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করে তত্ত্ব বের না করে লোকেরা যা করছেন, সেটা দেখে তার ভেতর থেকে তত্ত্বটা বের করেছি।’

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথা হয়তো কিছু সমালোচনার জবাব। যেমন, কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন এবারের অর্থনীতির নোবেল নিয়ে। কারণ, নতুন কোনো তত্ত্ব না, বরং গবেষণাপদ্ধতির উন্নয়ন ও প্রভাব বিবেচনায় তিনজন পেয়েছেন এবারের নোবেল। বিষয়টা অনেকটা এ রকম—অর্থনীতির সমস্যা হরেক রকমের। যেমন স্বাস্থ্য খাতে দুর্বলতা, শিক্ষায় ঘাটতি এবং দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণ না ঘটা, গরিব মানুষ গরিবই থেকে যাওয়া প্রভৃতি। আর এসবের কারণ খুঁজে সমাধান বার করার কাজটিই করেছেন এবারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ। নোবেল পাওয়া অন্য দুজন অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার। ঘটনাচক্রে এস্থার দুফলো অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। অর্থনীতিতে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে নোবেল পাওয়ার ঘটনাও বিরল।

নোবেল পেয়েছেন এই খবর পেয়ে গেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো। এরপরই বোস্টনে নিজেদের বাসার সামনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান তাঁরা দুজন। এএফপি
নোবেল পেয়েছেন এই খবর পেয়ে গেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো। এরপরই বোস্টনে নিজেদের বাসার সামনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান তাঁরা দুজন। এএফপি

পুরস্কারের ঘোষণায় নোবেল কমিটি জানায়, তাঁদের গবেষণা পুরো পৃথিবীকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে এই ত্রয়ীর গবেষণাপদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা পাল্টে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম মডেল। বলে রাখা ভালো, এই অর্থনীতিবিদ দম্পতির সঙ্গে নোবেল পাওয়া ৫৪ বছর বয়সী মাইকেল ক্রেমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। প্রতিবছরই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু সব পুরস্কার নিয়ে সমান আলোচনা হয় না, সব পুরস্কার সমানভাবে আন্দোলিতও করে না। অনেক কারণে এবারের নোবেল পুরস্কার নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে। বড় কারণ হচ্ছে, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বাঙালি। চতুর্থ বাঙালি হিসেবে তিনি এই পুরস্কার পেলেন। ১৯৯৮ সালে নোবেল পাওয়া আরেক বাঙালি অমর্ত্য সেন। নোবেল পাওয়া অন্য দুই বাঙালি হলেন সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিতে বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

নোবেল ঘোষণার পর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ নিয়ে যেমন আলোচনা হচ্ছে, তেমনি কথাবার্তা হচ্ছে তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে। রান্নায় পারদর্শিতা, তিহার জেলে ১০ দিন, বিবাহবিচ্ছেদ ও ফরাসি স্ত্রী, বিজেপির সঙ্গে শীতল সম্পর্ক—কত কিছুই না আলোচনার বিষয় এখন। অবশ্য বাঙালির নোবেল জয় নিয়ে একদল বাঙালি উচ্ছ্বসিত হবে, আরেক দল নিন্দা করবে, এ তো নতুন কিছু নয়।

কলকাতার ছেলে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
মা-বাবা দুজনেই অর্থনীতির অধ্যাপক। ছেলেও তা-ই। মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়। মা মারাঠি, কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসের অর্থনীতির অধ্যাপক। বাবা ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। তবে অভিজিতের জন্ম মুম্বাইয়ে, ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের নাম নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। তাঁর পুরো নাম অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় টুইট করে বলেছিলেন, ‘নামের মাঝে কেন “বিনায়ক” রয়েছে, কেন তাঁর বাবার নাম “দীপক” নেই। এর রহস্য কী?’ তাঁর মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এর জবাব দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেছেন, ‘অভিজিতের জন্ম তৎকালীন বোম্বেতে (এখন মুম্বাই)। ওর দাদু-দিদার বাড়ি ছিল সেখানে। মহারাষ্ট্রে নামের মধ্যে বাবার নাম বসানো হয় না। নামের মধ্যে বিনায়ক দিয়েছিলাম কারণ আমি মারাঠি। আমি চেয়েছিলাম যেহেতু আমি মারাঠি, তার একটা কিছু আভাস থাকুক ছেলের নামের মধ্যে। ছোটবেলায় আমার প্রিয় ঠাকুর ছিল বিনায়ক অর্থাৎ গণেশ। তা ছাড়া মহারাষ্ট্রে বিনায়ক নামটাও খুবই জনপ্রিয়।’

জবাব অন্যরাও দিচ্ছেন। একজন তো তথাগত রায়কে টুইট করে বলেই বসলেন, ‘আপনার নামের সঙ্গে তো “গত” আছে, কিন্তু আপনি তো গত হননি। এর রহস্য কী?’

অভিজিতের শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতাতেই। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৮১ সালে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ১৯৮৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

এখন তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক। এমআইটির শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত অভিজিৎ। বিশ্বের দরিদ্রদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য ২০১৩ সালে অভিজিৎ ও এস্থার দুফলো যুগ্মভাবে ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ গড়ে তুলেছিলেন। ২০০৩ সালে প্রথমে তৈরি হয় ‘পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’। এর দুই বছর পর এমআইটির এক প্রাক্তন ছাত্র অনুদান দিলেন। ওই ছাত্রের পিতার স্মরণে এর নতুন নাম হলো ‘আবদুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’। সংক্ষেপে বলা হয় জে-প্যাল। সারা বিশ্বের পাঁচটি শহরে তার দপ্তর রয়েছে।

আবদুল লতিফ জামিল ছিলেন একজন বড় সৌদি ব্যবসায়ী। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আবদুল লতিফ জামিল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবসা অগণিত। তিনি মারা যান ১৯৯৩ সালে।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম স্ত্রী অরুন্ধতী তুলি বন্দ্যোপাধ্যায় এমআইটির সাহিত্যের প্রভাষক। দুজনেই কলকাতায় একসঙ্গে বড় হয়েছেন। পরে তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। কবির বন্দ্যোপাধ্যায় নামের তাঁদের একটি ছেলেও ছিল। ২০১৬ সালে মারা যান তিনি। প্রথমে ছাত্রী, পরে গবেষণার সঙ্গী এস্থার দুফলো ২০১৫ সালে অভিজিতের জীবনসঙ্গী হন, তাঁরা বিয়ে করেন। ২০১২ সালে এই দম্পতির এক সন্তান জন্মলাভ করে।এখন তাঁদের দুটি সন্তান।

যুক্তরােষ্ট্রর বোস্টনে নিজেদের বাসার সামনে অভিজিৎ ও এস্থার দুফলো। এএফপি
যুক্তরােষ্ট্রর বোস্টনে নিজেদের বাসার সামনে অভিজিৎ ও এস্থার দুফলো। এএফপি


এস্থারের আগ্রহ ছিল ইতিহাসে
মা-বাবা অর্থনীতিবিদ। সুতরাং অভিজিতের অর্থনীতি পড়াই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু এস্থার দুফলোর অর্থনীতি পড়ার কথা ছিল না। প্যারিসে ১৯৭২ সালে জন্ম এস্থারের। বাবা গণিতের অধ্যাপক, মা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইতিহাসে আগ্রহ। একটু বড় হলে সরকারি চাকরি বা রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ১০ মাসের জন্য চলে যান মস্কোয়। সেখানে এস্থার ফ্রেঞ্চ শেখাতেন, পাশাপাশি গবেষণা করতেন ইতিহাস নিয়ে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন কী করে প্রপাগান্ডার জন্য স্তালিনগ্রাদের মতো বড় প্রকল্পকে ব্যবহার করত এবং প্রপাগান্ডার প্রয়োজনেই এসব প্রকল্প শেষ পর্যন্ত একটা ভালো অবস্থায় রূপ নিত। একই সময় এস্থার সেখানে একজন ফরাসি অর্থনীতিবিদের গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। সেই অর্থনীতিবিদ তখন সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাকসের সঙ্গেও কাজ করেছেন, যিনি তখন ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন পরামর্শদাতা। এরপর এস্থার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে মাস্টার্স করার পর চলে যান এমআইটিতে, ১৯৯৯ সালে সেখান থেকে পিএইচডি করেন। এমআইটিতে তাঁর সুপারভাইজার ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জসুয়া আনগ্রিস্ট। পিএইচডি শেষ হলে এস্থার এমআইটিতেই শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০২ সালে এস্থার দুফলো যখন সহযোগী অধ্যাপক হন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৯। এস্থার এমআইটির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপক। এখন তিনি অর্থনীতিতে সবচেয়ে কম বয়সী নোবেল বিজয়ী। আর বিশ্বের দ্বিতীয় নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন তিনি। তাঁর বয়স এখন মাত্র ৪৬।

একজন পেলে দুঃখ হতো মায়ের
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় থাকেন না। তবে আসা-যাওয়া আছে। কারণ মা থাকেন সেখানে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকেরা ভিড় করছেন মায়ের বাসায়। নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে কী খেতেন, কী ভালোবাসতেন—এ ধরনের প্রশ্নও আছে। যেমন তবে টেলিফোনে কী কথা হতো? এর জবাবে মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘ও তো ১৯৮৩-তে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে পড়াশোনা করতে। তারপর থেকে বাইরে বাইরেই। কী খেলে, কেমন আছ, এসব কথা আমাদের প্রায় হয়ই না। ওর কাজ নিয়েই কথা হয়। সারা বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে কাজ করছে ও। সেসব নিয়েই কথা হতো। আমাদের দেশের অর্থনীতি যে দিকে এগোচ্ছে, সেসব নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছে ও। এসব নিয়েই কথা হতো।’

কলকাতার বাড়িতে মা িনর্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতার বাড়িতে মা িনর্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়

আর রান্নাবান্না? অভিজিৎ নিজেই রান্না করতে খুব ভালোবাসেন। বিশেষ করে মাছের রান্না ভালো জানেন। আর একসময় মা-ছেলে মিলে কেক তৈরি করতেন। ছেলে রান্না শিখেছেন নিজে নিজেই। একই সঙ্গে খেলাধুলা করতেও ভালোবাসেন। টেবিল টেনিস, লন টেনিস ভালো খেলেন। গান শোনায়ও খুবই আগ্রহ। বই পড়ার অভ্যাস তো রয়েছেই—তাও জানালেন অভিজিতের মা।

নোবেল পাওয়া পুত্রবধূ নিয়েও উচ্ছ্বসিত নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, ‘বিয়ের অনেক আগে থেকেই কলকাতায় আমাদের বাড়ি আসত ও। ওরা একসঙ্গেই কাজ করেছে। ছেলে ও পুত্রবধূ একই সঙ্গে নোবেল পাওয়ায় আমি খুশি। বউমা নোবেল পাওয়ায় আমি আরও উচ্ছ্বসিত। একজন পেলে বরং দুঃখ হতো।’

বাবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা
আনন্দবাজার পত্রিকা অভিজিতের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে নতুন এবং মজার কিছু তথ্য দিয়েছে। যেমন একবার চাপে পড়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে, নিউ এম্পায়ার হলে দেখা সেই সিনেমার নাম ছিল স্টার ওয়ারস। সেদিনই কলেজে অর্থনীতির ক্লাস ছিল তাঁর বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

আরকটি তথ্য হচ্ছে, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকনাম ‘ঝিমা’। সবাই এ নামেই ডাকত। ঝিমার ঝোঁক ছিল পাশ্চাত্য সংগীত ও বিদেশি সিনেমার প্রতি। শাস্ত্রীয় সংগীত আর উর্দু ভাষায়ও আগ্রহ ছিল। এক বন্ধু, তাঁর নামও অভিজিৎ। তিনি জানান, তাঁদের দুজনেরই হাতের লেখা খুব খারাপ ছিল। তবে রেজাল্ট ছিল খুব ভালো। পরে একবার বন্ধুর কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, এত খারাপ লেখা নিয়ে তিনি কী করে এত ভালো ফল করেন। উত্তরে অভিজিৎ তাঁকে জানান, কেউ একজন তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন পরীক্ষার খাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখতে, যাতে হাতের লেখা খারাপ হলেও পরীক্ষক বুঝতে পারেন।

তিহার জেলে ১০ দিন
ছাত্রজীবনে জেলও খেটেছিলেন অভিজিৎ। ১৯৮৩ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতিকে বরখাস্ত করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। তার জেরে অভিজিৎসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। উপাচার্যের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ১০ দিন তিহার জেলে ছিলেন তিনি।

২০১৬ সালে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জেলে থাকার সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভর্তিপ্রক্রিয়া বদলানোর দাবিতে আন্দোলন হচ্ছিল। ফি এত বাড়িয়ে দেওয়া হয় যে তা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্র সংসদ এর প্রতিবাদ করায় তৎকালীন ছাত্র সংসদের সভাপতিকে বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার পরই ছাত্র আন্দোলন আরও তীব্র হয়। সেই আন্দোলন দমন করতেই পুলিশ ঢোকে ক্যাম্পাসে। আমাদের মারতে মারতে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্দেহ নেই, এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল।’

অভিজিৎ সেই সাক্ষাৎকারে আরও বলেছিলেন, ‘গ্রেপ্তার করার পর তিহার জেলে নিয়ে পুলিশ আমাদের মারধর শুরু করে। আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ না আনা হলেও হত্যাচেষ্টাসহ একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। পরে অবশ্য সেই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। তবে জেলে ১০ দিন বন্দী ছিলাম আমরা।’

ডেভেলপমেন্ট টি
জে-প্যালের কাজের ধরন হলো হাতে-কলমে বিভিন্ন নীতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে তার ভিত্তিতে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণ। এ জন্য সেখানে যে বৈঠকগুলো হয় তার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। এ নিয়েও এখন লেখালেখি হচ্ছে বিস্তর। যেমন বৈঠকটির একটি নাম আছে। প্রতি সপ্তাহে হয়। চা খেতে খেতে মিটিং বলেই এর নাম ‘ডেভেলপমেন্ট টি’। অভিজিৎ ও সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য একসঙ্গে একটি বই লিখেছিলেন। কাছ থেকে দেখেছেন গবেষণাপদ্ধতি। স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘সেখানে কিছুদিন থাকার সুবাদে এক চা-বৈঠকে দেখি, বিষয় গরু চুরি। আফ্রিকার কোন দুই দেশের মধ্যে নাকি ভারি অশান্তি, এ দেশের লোক সীমান্ত পেরিয়ে ও দেশের গরু লুট করে। তারা বদলা নেয়। গবেষণার বিষয়: এ কি স্রেফ অপরাধ, নাকি খরায় রোজগার মার খেলে গরু চুরি বাড়ে? শুনতে শুনতে মনটা সরে গিয়েছে, হঠাৎ সংবিৎ ফিরল সুন্নতের কথা কানে আসতে। কী সর্বনাশ, গরু চুরির সঙ্গে, সুন্নতের কী? ক্রমে বোঝা গেল, ছেলেদের সুন্নত উপলক্ষে ভোজ দেওয়ার চল আছে ওই সব অঞ্চলে। খরা হলে ভোজ দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই দেখা চাই, ভোজবাড়ি কমলে গরু লুট বাড়তে পারে, এমন আগাম বলা যায় কি না।’

আর এই বৈঠকের নোটিশ কীভাবে যায়, সেটাও বলি। ই-মেলে লেখা হয়, ‘অমুক দিন ডেভেলপমেন্ট টি। চা-বিস্কুট আমি আনব, তোমরা আইডিয়া নিয়ে এসো।’

বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক
ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভালো ছিল না অভিজিতের। তিনি নরেন্দ্র মোদির নোট বাতিলসহ নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কড়া সমালোচক। ফলে নরেন্দ্র মোদির ভক্তরা অনেকটাই নিস্পৃহ, কেউ কেউ সমালোচনামুখর। খোদ প্রধানমন্ত্রীই পুরস্কার ঘোষণার চার ঘণ্টা পর সাদামাটা একটি টুইট করেছেন মাত্র। তিনি সেখানে লেখেন, ‘অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে আলফ্রেড নোবেল স্মৃতি স্তেরিয়াস রিক্সবাঙ্ক পুরস্কার পাওয়ার জন্য অভিজিৎ ব্যানার্জিকে অভিনন্দন। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।’

নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরপরই এমআইটিতে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে ভারত নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর মাতৃভাষা বাংলায় দিয়েছেন। একটি প্রশ্ন ছিল, মোদি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সময় ভারতের অর্থনীতি কেমন চলছে। অভিজিতের জবাব ছিল, ‘আমার মতে, (ভারতের) অর্থনীতির হাল এখন খুব খারাপ। সরকারের রাজকোষে ঘাটতি বিপুল। তবু তারা সকলকে খুশি করার জন্য চেষ্টা করছে। আর তার পরও ভান করছে, বাজেটে ঘোষিত ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা যাবে। আর শুনতে ভালো লাগে বা রাজনৈতিক ফায়দা রয়েছে, এমন প্রকল্প ঘোষণার প্রবণতা ভারতের দীর্ঘদিনের। কিন্তু সরকারের উচিত এমন সব প্রকল্প ঘোষণা করা, যা সত্যি সত্যিই কাজে আসবে, গরিব মানুষের কাজে লাগবে। তাদের হাতে টাকা জোগাবে।’

এসব কথাও নিশ্চয়ই বিজেপি সরকারের কারও ভালো লাগেনি। যেমন অমর্ত্য সেনের কথাও বিজেপির ভালো লাগে না। কিন্তু এবারের অর্থনীতির নোবেল সঠিক তিনজনের কাছে যে গেছে, এ নিয়ে সংশয়বাদীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। আর তাইতো নোবেলজয়ী আরেক বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও অভিজিতের নোবেল পাওয়ায় বেজায় খুশি। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে বার্তা সংস্থা পিটিআইকে তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকেই এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।’