সিমেন্টের চাহিদা বাড়িয়েছে সরকারি প্রকল্প

>

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

দেশে একের পর এক বড় বড় স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, যা সিমেন্টের চাহিদা বাড়াচ্ছে। ফলে বড় হচ্ছে সিমেন্টের বাজার। দেশের সিমেন্টের বাজারের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সমস্যার কথা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্টের (ফ্রেশ ও মেঘনাসেম ডিলাক্স ব্র্যান্ড) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন

প্রথম আলো: সিমেন্টের বাজারের বর্তমান অবস্থা কী?

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম: গত ৯ মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) হিসাবে দেখা যাচ্ছে সিমেন্টের বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ। বছর শেষে তা ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। গত বছর শেষে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। সেই হিসাবে বলা যায়, গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রবৃদ্ধি একটু কমবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই কোটি টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে। আশা করছি, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টনে।

প্রথম আলো: এ বছর শেষে প্রবৃদ্ধি গত বছরের চেয়ে অনেক কম হবে। এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি এত কমে যাওয়ার কারণ কী?

খোরশেদ আলম: এ বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বড় কারণ সরকারি কয়েকটি বড় প্রকল্পে সিমেন্টের ব্যবহার কমে যাওয়া। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, গত বছর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পেই এককভাবে ১২ লাখ টন সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছে। এ বছর সেখানে সিমেন্টের ব্যবহার এখন পর্যন্ত খুবই কম। এ ছাড়া এ বছরটি সরকারের নির্বাচন পরবর্তী প্রথম বছর। এ কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে কিছুটা ধীর গতি ছিল। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যেকোনো সরকারের মেয়াদের দুই থেকে আড়াই বছরে গিয়ে বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের কাজে গতি আসে। সেই হিসাবে এ বছর প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হলেও আগামী বছরগুলোতে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতে মাতারবাড়ি, রামপাল, পায়রা, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বড় প্রকল্পের কাজে গতি আসবে। তাতে সিমেন্টের চাহিদাও বাড়বে বলে আমাদের ধারণা।

প্রথম আলো: তার মানে, বর্তমানে সিমেন্টের চাহিদার বড় অংশ সরকারি প্রকল্পনির্ভর। তাহলে বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে কি সিমেন্টের ব্যবহার কমে গেছে?

খোরশেদ আলম: কয়েক বছর আগেও ব্যক্তি খাতে সিমেন্টের চাহিদা ছিল মোট বাজারের ৬০ শতাংশ। অন্য খাতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন ব্যক্তি খাতের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। এ ছাড়া বর্তমানে সিমেন্টের বাজারের ২৫ শতাংশ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নকাজ, ১০ শতাংশ শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবন, ১০ শতাংশ আবাসন খাত এবং বাকি ৫ শতাংশ বৈদ্যুতিক খুঁটি ও কংক্রিটের দখলে রয়েছে। সরকারি মেগাপ্রকল্প ও উন্নয়নমূলক কাজে সিমেন্টের চাহিদা যে হারে বেড়েছে ব্যক্তি খাতে সেভাবে বাড়েনি। আমরা আশা করছি, সরকারি বড় বড় উন্নয়নকাজ শেষ হলে ব্যক্তি খাতের চাহিদা আবারও বাড়বে। কারণ, সরকারি উন্নয়নকাজের পরই ব্যক্তি খাত এগিয়ে আসে। সব ধরনের চাহিদা মিলিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে মাথাপিছু সিমেন্টের চাহিদা ২০০ কেজির নিচে রয়েছে। সরকারি উন্নয়নকাজের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ চাহিদা বেড়ে মাথাপিছু ৫০০ কেজিতে উন্নীত হবে বলে আমাদের আশা। আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখি, ২০১২ সালেও এ দেশে সিমেন্টের মাথাপিছু চাহিদা ছিল ৮০ কেজির মতো। ৬–৭ বছরের ব্যবধানে তা প্রায় আড়াইগুণের বেশি বেড়েছে।

প্রথম আলো: সিমেন্টের বাজারে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থান কোথায়?

খোরশেদ আলম: ২০১৬ সাল থেকে সামগ্রিক বাজার প্রবৃদ্ধির চেয়ে আমাদের কোম্পানির বিক্রি প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি ছিল। ২০১৬ সালে যেখানে বাজারের প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশ, সেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিক্রি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে বাজার প্রবৃদ্ধি ছিল সোয়া ৮ শতাংশের মতো, আর আমাদের বিক্রি প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৩ শতাংশের বেশি। আর ২০১৮ সালে বাজার প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ,সেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে বাজার প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের মতো, সেখানে আমাদের কোম্পানির বিক্রি প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশের কাছাকাছি।

প্রথম আলো: বাজারের চেয়ে অনেক বেশি হারে আপনাদের কোম্পানির প্রবৃদ্ধির কারণ কী?

খোরশেদ আলম: প্রথম কারণ হচ্ছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি এবং তা আরও বাড়ছে। সরকারি বড় বড় কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে এককভাবে আমাদের ফ্রেশ সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে। আমরা আমাদের সিমেন্টের গুণগত মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি বিক্রির ক্ষেত্রে ভোক্তাবান্ধব নানা নীতি গ্রহণ করেছি। এ ছাড়া সময়মতো পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের বিষয়টিও আমরা কঠোরভাবে পরিপালন করেছি। এসব কারণে আমাদের বিক্রি বাজারের প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে।

প্রথম আলো: সরকারি কোন কোন প্রকল্পে আপনাদের সিমেন্টের ব্যবহার বেশি হয়েছে?

খোরশেদ আলম: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দ্বিতীয় কাঁচপুর, গোমতী ও মেঘনা সেতুতে এককভাবে আমাদের কোম্পানির সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছে। এ তিনটি ব্রিজ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিল জাপানের দুটি সংস্থা। তারাই মূলত এ কাজের জন্য আমাদের সিমেন্ট বাছাই করেছে। কারণ, তাদের চাহিদা অনুযায়ী সিমেন্টের মান আমরা নিশ্চিত করেছি। এর বাইরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ সরকারি বড় বড় বেশ কিছু প্রকল্পে আমাদের সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে। তবে সেসব প্রকল্পে আমাদের সিমেন্টের পাশাপাশি অন্য কোম্পানির সিমেন্টেরও ব্যবহার হয়েছে।

প্রথম আলো: সিমেন্ট খাতের প্রধান সমস্যা কী?

খোরশেদ আলম: সিমেন্টের কাঁচামাল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। আগে চীন সিমেন্টের কাঁচামাল নিজেরাই উৎপাদন করত। পরিবেশগত কারণে এখন চীনে ক্লিংকারের উৎপাদন প্রায় বন্ধ। চীনে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ক্লিংকারের দামেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা, বন্দরের জাহাজ জট। কারণ, পণ্য খালাসে বাড়তি সময় লাগে। তৃতীয় সমস্যা, বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলনায় সিমেন্ট খাতের উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি। এ কারণে বিদ্যমান বাজার ধরে রাখতে এবং হিস্যা বাড়াতে কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক ধরনের মূল্যযুদ্ধ চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। টাকার মান কমে যাওয়ায় আমাদের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় দাম বাড়েনি সিমেন্টের। উল্টো কমে গেছে। ২০১২ সালেও প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) সিমেন্টের দাম ছিল ৪৬০ টাকা। এখন তা কমে ৪০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে গত বাজেটে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে সিমেন্ট খাতে করের চাপ বেড়ে গেছে। এর ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ছোট ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।