ব্যবসায়ীরা ট্রেড লাইসেন্স পেতে হয়রানির শিকার

মাসুদুর রহমান, সভাপতি,  বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
মাসুদুর রহমান, সভাপতি, বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
>

ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানামুখী শিল্পকারখানার জন্য বগুড়ার ঐতিহ্য রয়েছে। স্বাধীনতার পর নানা সংকটে পড়ে কিছু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও এখন আবার নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। স্থানীয় শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা, সংকটসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ। 

প্রথম আলো: বগুড়ার শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য বহু বছরের। এখন অবস্থা কেমন?

মাসুদুর রহমান: স্বাধীনতার আগে কটন মিল, স্পিনিং মিল, তাঁত, গ্লাস, সিরামিক, সাবানশিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল বগুড়া। কয়েক বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে পাট ও কাগজের কল; রাইস ব্র্যান অয়েল বা ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেল, পিভিসি পাইপ, টাইলস, ওষুধ, ফাউন্ড্রি, হালকা প্রকৌশল, কৃষি পণ্যসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন প্রায় তিন হাজার কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এখানে।

প্রথম আলো: কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের বড় বাজার বগুড়া। এ শিল্পের বর্তমান অবস্থা কী?

মাসুদুর রহমান: বগুড়ায় ৩৮টি ফাউন্ড্রি কারখানা, সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প তৈরির প্রায় ৩৫০টি কারখানাসহ হালকা প্রকৌশল ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কয়েক হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে। সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, টিউবওয়েল, ধানমাড়াই যন্ত্র, সেচপাম্পসহ কৃষি যন্ত্রপাতি রপ্তানি হচ্ছে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে।

প্রথম আলো: আদমজী পাটকল বন্ধ হওয়ার পর বগুড়ায় বেসরকারি উদ্যোগে অনেক পাটকল গড়ে উঠেছে। কেমন চলছে এসব পাটকল?

 মাসুদুর রহমান: ২০০২ সালে আদমজী বন্ধের পর সেখানকার পুরোনো যন্ত্রাংশ দিয়ে বগুড়ায় পাটশিল্পের নবযাত্রা শুরু। গত ১৭ বছরে এখানে ২০টি পাটকল গড়ে উঠেছে। এর সব কটিই লাভজনক। এখন পাটকলের যন্ত্রাংশও তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়। স্থানীয় কৃষকেরাও পাট চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। পাটকলে উৎপাদিত সুতা, ব্যাগ, বস্তা ইত্যাদি রপ্তানি হচ্ছে ভারত, জার্মানি, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

প্রথম আলো: বগুড়ার আর কী কী পণ্য রপ্তানি হচ্ছে?

মাসুদুর রহমান: ধানের কুঁড়ার তেল, ডিজিটাল স্কেল বা পাল্লা, নকশিকাঁথা ইত্যাদি পণ্যও রপ্তানি হচ্ছে।

প্রথম আলো: বগুড়ায় শিল্পকারখানা সবই তো জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ আপনারা নিচ্ছেন কি?

মাসুদুর রহমান: পরিকল্পিত শিল্পনগরী গড়তে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগর প্রকল্প অনিশ্চিত। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে সরকার উদ্যোগ নিলেও জমি নিয়ে মামলার কারণে প্রকল্প আটকে আছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

প্রথম আলো: বগুড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান সমস্যা কী কী বলে মনে করেন?

মাসুদুর রহমান: ট্রেড লাইসেন্স ফি বেড়েছে। পৌরসভায় এই লাইসেন্স নিতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শিল্পমালিকদের ওপর হোল্ডিং ট্যাক্স চাপানো হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আবার নতুন শিল্পকারখানায় গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় শিল্পকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

প্রথম আলো: গত কয়েক বছরে বগুড়ায় আবাসন খাতে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। এ খাতের সম্ভাবনা কেমন?

মাসুদুর রহমান: হ্যাঁ, এখানকার আবাসন খাতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

প্রথম আলো: ব্যাংকে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কোনো প্রভাব পড়ছে কি?

মাসুদুর রহমান: ভালো ব্যবসা হলে এবং ভালো বিনিয়োগকারীর জন্য বর্তমান সুদহার কোনো সমস্যা নয়। বগুড়ায় ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার জন্য ব্যাংক নয়, উদ্যোক্তারাই দায়ী। অনেকেই ব্যাংক থেকে এক খাতের জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করেছেন। অনেকে খেলাপি হয়ে ব্যাংকগুলোর আস্থা নষ্ট করেছেন। এতে ভালো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

প্রথম আলো: বগুড়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

মাসুদুর রহমান: বিনিয়োগকারীরা বগুড়ায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা করতে আগ্রহী। কিন্তু বড় সমস্যা শুধু পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থায়। সড়কপথে রাজধানী থেকে বগুড়ায় আসতে আট ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। এ কারণে অনেকে বগুড়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসছেন না। বগুড়ায় শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই বিমান যোগাযোগ চালু করতে হবে। দীর্ঘদিনের দাবি এটি। পাশাপাশি বগুড়াকে সিটি করপোরেশন ঘোষণা করলে উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী হবেন।