'দারিদ্র্যমুক্ত' হওয়ার পথে সাফল্য

এ দেশের মানুষের জন্য একটি বড় সুখবর। অতিদারিদ্র্যের হার এ বছর এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। গত জুন মাস শেষে অতিদারিদ্র্যের হার ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। গত ১০ বছরে প্রায় এক কোটি লোক নিজেদের হতদরিদ্র অবস্থা কাটানোর যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন।

অতিদারিদ্র্যের হারকেই আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা হিসেবে ধরা হয়। কোনো দেশে এ হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে এলে ওই দেশকে ‘দারিদ্র্যমুক্ত দেশ’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) মূল উদ্দেশ্য দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।

গত অক্টোবর মাসে তৈরি করা জিইডির সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে এক প্রতিবেদনে দারিদ্র্য পরিস্থিতির হালনাগাদ এই চিত্র উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ক্রয়সক্ষমতার সমতা (পিপিপি) অনুসারে কোনো ব্যক্তি দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করতে পারলেই ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয় না। এসডিজি অনুযায়ী, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হওয়ার ক্ষেত্রে এই হিসাবকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে, এটিই এসডিজির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

তবে প্রতিটি দেশের আলাদা আলাদা জাতীয় দারিদ্র্যসীমা আছে। বাংলাদেশের সেই দারিদ্র্যের হার বিদায়ী ২০১৮–১৯ অর্থবছর শেষে ছিল ২০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে ৫ থেকে ৬ বছর পরপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপের মাধ্যমে দারিদ্র্য পরিস্থিতি গণনা করে থাকে। আর পরিকল্পনা কমিশন ওই জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর একটি অনুমিত হিসাব তৈরি করে থাকে।

গত মে মাসে বিবিএসের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখ জনগোষ্ঠী আছে। সেই হিসাবে, হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা এখনো ১ কোটি ৬০ লাখের মতো। সব মিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া তিন কোটি মানুষ।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে অবশ্যই আমাদের সাফল্য আছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো, এই সাফল্য ধরে রাখা। মৌলিক চাহিদা মেটানোর মতো সক্ষমতা গড়ে তোলার মাধ্যমে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও আছে।’

জাহিদ হোসেনের মতে, হতদরিদ্র অবস্থার উন্নতি হলেও দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। তারা যেকোনো কারণে আবার গরিব হয়ে যেতে পারে। তাই শিক্ষার মান বাড়িয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। যাতে তাঁরা আনুষ্ঠানিক খাতে ভালো ও বেশি মজুরির কাজ পান। এতে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে।

কত কমল হতদরিদ্র ব্যক্তির হার
এবার আসি, গরিবি হটানোর যুদ্ধে কত লোক জয়ী হলো। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে এ দেশে প্রায় অর্ধেক মানুষই হতদরিদ্র ছিল। তখন হতদারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত এই পরিস্থিতির খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানামুখী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নেওয়ায় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। দারিদ্র্য হটানোর নানা কর্মসূচি আরও বেশি গতি পায় ২০০০ সালের পর।

২০০৯ সালের পর গত ১০ বছরে প্রায় ১ কোটি হতদরিদ্র মানুষ তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম ফেলেছে। আবার কেউ জাতীয় দারিদ্র্যসীমার আশপাশেই আছে। তবে তাদের কেউ আর হতদরিদ্র নেই। সরকারি তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে এসে অতিগরিব বা হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখে।

>২০১০ সালে হতদরিদ্রের সংখ্যা ২ কোটি ৫৮ লাখ, এখন ১ কোটি ৬০
স্বাধীনতার পর দেশের অর্ধেক মানুষ হতদরিদ্র ছিল
দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করলেই দরিদ্র নয়


পরিকল্পনা কমিশনের জিইডি সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০৩০ সালের আগে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সরকার সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তাকৌশল নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের শেষের দিকে এসে গতি কিছুটা কমে যায়। কিছু এলাকা ও জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বিশেষ উদ্যোগও নিচ্ছে।

মাথাপিছু আয় পেরোবে ২ হাজার ডলার
চলতি অর্থবছরেই মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলার পেরিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সোয়া ৮ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আবার গত ১০ বছরে প্রতিবছর গড়ে ১২৩ মার্কিন ডলার করে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এসব বিবেচনায় চলতি অর্থবছরেই মাথাপিছু আয়ের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করবে দেশের অর্থনীতি।

সর্বশেষ গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। ঠিক ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭৬ ডলার।

স্বাধীনতার পর মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলার পার করতে লেগেছে ৪০ বছরের বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ১১০ ডলার হয়। পরের পাঁচ বছরে তা প্রায় ২ হাজার ডলারের কাছাকাছি চলে যায়। মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির আয় নয়, দেশের মোট আয়কে জনগোষ্ঠী দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়।