উৎপাদনের মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত

মোহাম্মদ ইদ্রিস, সাধারণ সম্পাদক,  হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতি
মোহাম্মদ ইদ্রিস, সাধারণ সম্পাদক, হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতি
>

দেড় মাস ধরে অস্থির পেঁয়াজের বাজার। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে পেঁয়াজের দামে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। পেঁয়াজের বর্তমান অবস্থা, বাজারে অস্থিরতার নেপথ্য কারণ, সরকারের করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলছেন পেঁয়াজের পাইকারি আড়ত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ

প্রথম আলো: পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার কারণ কী?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: পেঁয়াজ আমদানিতে আমরা সব সময় ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই সংকট শুরু হয়। গত মাসে ভারত থেকে পুরোনো ঋণপত্রের বিপরীতে কিছু পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল। আবার মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ আমদানি বেড়েছিল। দাম বাড়লেও বাজারে পেঁয়াজ ছিল। এখন ভারত থেকে পুরোনো ঋণপত্রের বিপরীতে পেঁয়াজ আসছে না। মিয়ানমার থেকেও আমদানি কমে গেছে। এতে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ঘাটতি হলে স্বাভাবিকভাবেই অস্থিরতা হবে। বাজারে এখন যে দাম বাড়ছে, তার কারণও সরবরাহ সংকট। সরবরাহ যদি পর্যাপ্ত থাকত, তাহলে দাম এত বাড়ত না। বাজারও অস্থির হতো না।

প্রথম আলো: খাতুনগঞ্জের বাজার এখন কেমন?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: খাতুনগঞ্জে এখন কোনো আড়তে পেঁয়াজ আছে, কোনো আড়তে নেই। এখন যেহেতু সারা দেশের ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জ থেকে পেঁয়াজ নিচ্ছেন, সে কারণে এখানে হাহাকারও বেশি। যেভাবে দেশের দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কেনার জন্য এখানে আসছেন, তাতে প্রতিদিন দুই হাজার টনের মতো চাহিদা আছে। অথচ গড়ে ১০০ টনের বেশি পেঁয়াজ আসছে না এখানে। চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ সরবরাহ না থাকায় দামও চড়া।

প্রথম আলো: চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৪২ টাকায় আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা। এই পেঁয়াজের দাম এত বেশি কেন?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: এখানে বড় ধরনের তথ্যের ঘাটতি আছে। টেকনাফ স্থলবন্দরের তথ্য যদি আপনি দেখেন, সেখানে দেড় মাস ধরে প্রতিটি পেঁয়াজের চালান ৫০০ ডলার বা ৪২ টাকা দরে আমদানি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো পণ্যের দাম কি দেড় মাস একই থাকে? বাস্তব সত্য হচ্ছে, এখন মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে কেজিপ্রতি ১০০ টাকার মতো খরচ পড়ছে। কাস্টমস তা দেখাচ্ছে না। এই ভুল তথ্যের ওপর পাইকারি পর্যায়ে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ৮০-৮৫ টাকা নির্ধারণ করেছিল জেলা প্রশাসন। অভিযানের মুখে আমদানিকারকেরাও পেঁয়াজ আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ১০০ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনে ৮৫ টাকা দরে তো বিক্রি করবে না কেউ।

প্রথম আলো: পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেড় মাস ধরে পেঁয়াজের বাজারে সংকট চলছে। সরকার যদি চাহিদা, আমদানি ও ঘাটতির সঠিক তথ্য–উপাত্ত নিয়ে পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিত, তাহলে এ অবস্থা হতো না। দরকার ছিল ব্যবসায়ীরা যাতে পেঁয়াজ আমদানি করেন, সে জন্য তাঁদের নিশ্চয়তা দেওয়া। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে মিয়ানমার বা অন্য দেশ থেকে সরকারি পর্যায়েও কিছু পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা দরকার ছিল। এসব না করে নভেম্বরে বড় চালান আসবে, শিগগিরই ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে—এমন প্রচারণা চালিয়ে ছোট আমদানিকারকদের নিরুৎসাহিত করা
হয়েছে। এখন দেখুন, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েও বড় কোনো চালান আসেনি। ভারতও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। এসব খবরে কিন্তু আমদানি কমেছে। সংকট তীব্র হয়েছে। সরকার যদি স্থায়ীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে দেশি পেঁয়াজের মৌসুমে আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। আমদানি নিষিদ্ধ করলে ভালো দাম পাবেন কৃষকেরা। কৃষকেরা একবার দাম পেলে পরের মৌসুমে উৎপাদন বাড়াবেন। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বেশি সময় লাগবে না।

প্রথম আলো: পেঁয়াজের বাজার কখন স্বাভাবিক হতে পারে?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: সময় ধরে এটা বলা কঠিন। ভারত যদি কাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, তাহলে কালকেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আবার তুরস্ক, চীন ও মিসরের মতো দেশগুলো থেকে দিনে দুই থেকে তিন হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি হলে বাজার স্বাভাবিক হতে পারে। এসব দেশের পেঁয়াজের সরবরাহ যদি পর্যাপ্ত হতো, তাহলে বাজারে পেঁয়াজের দর ৮০–৮৫ টাকার নিচে নামত। কারণ, এসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে খরচসহ সর্বোচ্চ দাম পড়ে ৫০ টাকার মতো। বাজারে দেশি পেঁয়াজের ফলন আসবে ডিসেম্বরের শেষ ও জানুয়ারির শুরুতে। তখনো দাম কমতে পারে।

প্রথম আলো: পাইকারি বাজারে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বলে প্রশাসন থেকে অভিযান চালানো হয়েছিল। জরিমানাও করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

মোহাম্মদ ইদ্রিস: চাক্তাই–খাতুনগঞ্জে মূলত আড়তে পেঁয়াজ বেচাকেনা হয়। পেঁয়াজ বেচাকেনার যে প্রক্রিয়া তা হলো, আমদানিকারকেরা আড়তে পেঁয়াজ পাঠিয়ে দেন। এরপর তাঁরাই দর ঠিক করে দেন। তাঁরা যেভাবে দর দেন আড়তদারেরা সেভাবেই বিক্রি করেন। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করলে ৫০ পয়সা কমিশন পান আড়তদারেরা। পেঁয়াজের দাম যাই হোক, আড়তদারেরা নির্ধারিত কমিশনের বেশি পান না। অবশ্য এখন খাতুনগঞ্জে অনেক আড়তে আমদানিকারকেরা পেঁয়াজ পাঠাচ্ছেন না। সে জন্য আড়তদারেরা নিজেরাই পেঁয়াজ কিনে বিক্রি করছেন। আমদানিকারকেরা দর না কমালে আড়তেও দাম কমার কারণ নেই।