পেঁয়াজের ট্রাক আসার আগেই দীর্ঘ লাইন

টিসিবির ট্রাক কখন আসবে, আদৌ আসবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কেনার জন্য রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে শ দেড়েক মানুষ। বাজারে পেঁয়াজের কেজি যে ২৪০ টাকা ছুঁয়েছে! গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর খামারবাড়িতে।  ছবি: আশরাফুল আলম
টিসিবির ট্রাক কখন আসবে, আদৌ আসবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কেনার জন্য রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে শ দেড়েক মানুষ। বাজারে পেঁয়াজের কেজি যে ২৪০ টাকা ছুঁয়েছে! গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর খামারবাড়িতে। ছবি: আশরাফুল আলম

তখন দুপুর সোয়া ১২টা। রাজধানীর খামারবাড়ি চত্বরের এক পাশে শ দেড়েক মানুষের জটলা। ওই স্থানে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পেঁয়াজ বিক্রি হয়। গতকাল শনিবার তাঁরা সেখানে ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে যান, বাজারে যার কেজি ২৪০ টাকা ছুঁয়েছে।

অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের একজন মরিয়ম বেগম জানালেন, তিনি এসেছেন সকাল আটটায়। নয়টার দিকে কালো গেঞ্জি পরে কেউ একজন সিরিয়াল লিখছে। কিন্তু এখন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পেঁয়াজের ট্রাক আসবে কি না, তা–ও বুঝতে পারছেন না।

মরিয়ম বেগম বলেন, এমন লাইন ধরে চাল-ডাল কিনেছেন ২০০৮ সালের দিকে। তিনি যেখানে বসে ছিলেন, তাঁর উল্টো পাশেই একটি মাঠে বসত তৎকালীন বিডিআরের ন্যায্যমূল্যের দোকান। এরপর গত ১০ বছরে তাঁকে কখনো এভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।

বেলা একটার দিকে খামারবাড়িতে টিসিবির ট্রাক যায়। মানুষ হুড়মুড়িয়ে পড়েন পেঁয়াজ কেনার জন্য। রাজধানীতে এমন ৩৫টি ট্রাকে দিনে ১ হাজার কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রি করে টিসিবি। একটি ট্রাক থেকে ৫০০ জন পেঁয়াজ কিনতে পারেন। ঢাকায় টিসিবির এ ব্যবস্থা থাকলেও দেশের বাকি জেলাগুলোতে দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই।

টিসিবি গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। গতকাল ঢাকার বড় বাজারগুলোতে খুচরায় দেশি পেঁয়াজ ছিল কেজিতে ২৩০–২৪০ টাকা, মিয়ানমারের ২৩০ টাকা ও চীনা পেঁয়াজ ২১০ থেকে ২২০ টাকা।

অবশ্য ঢাকায় গতকাল পাইকারি বাজারে দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে দেশি কিং নামের পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। অবশ্য খাঁটি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা কেজি। গত শুক্রবার একই বাজারে দেশি পেঁয়াজ ২৪০ টাকায় উঠেছিল। মিয়ানমারের ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হয় ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজিতে।

শ্যামবাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাহিদ বলেন, দু-এক মাস আগেও শ্যামবাজারে দিনে গড়ে ৩০০ টন পেঁয়াজ বিক্রি হতো। এখন আড়ত প্রায় ফাঁকা।

শ্যামবাজারের পাশাপাশি কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ফরিদপুর ও পাবনার পাইকারি বাজারে গতকাল সরেজমিনে জানা যায়, চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ কম।

কারওয়ান বাজারের আড়তে বিক্রেতা আবদুল মান্নান ২২০ টাকা কেজিতে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে বাজারে শত শত বস্তা পেঁয়াজ থাকে। এখন কত বস্তা আছে, সেটা গুনেই দেখুন।’

খাতুনগঞ্জে এখন কোনো আড়তে পেঁয়াজ আছে, কোনোটিতে নেই। হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার থেকে শুক্রবার দিবাগত রাতে ৭৮ টন পেঁয়াজ এসেছে। বিক্রি করার পর ৫০-৬০ টন ছিল। স্বাভাবিক সময়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টন পেঁয়াজ মজুত থাকে।

পাবনা দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনের কেন্দ্র। জেলার সুজানগর উপজেলার সবচেয়ে বড় পেঁয়াজের পাইকারি হাট পৌর বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। বিগত বছরের এই সময়টাতে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ ট্রাক পেঁয়াজ বিক্রি হতো। গত বুধবার সর্বশেষ হাটে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে তিন ট্রাক।

সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুজিৎ দেবনাথ বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কোথাও কোনো মজুত পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি।

পাবনার মতো ফরিদপুরও পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। জেলার সালথার উপজেলা–সংলগ্ন বোয়ালমারীর ময়েন দিয়া বাজারে গতকাল সকালে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার টাকা মণ দরে (প্রতি কেজি ১৭৫ টাকা)। তবে দুপুরের পরে পেঁয়াজের দাম মণপ্রতি ৫০০ টাকা কমে যায়।

সরকার বুঝতে পারেনি

ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, এ বছর পেঁয়াজের সংকট হবে, সেটা আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল। কিন্তু পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয় দেরি করে ফেলেছে। এখন পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম বলে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে আরও ১ লাখ ৯৭ হাজার টন পেঁয়াজ। সব মিলিয়ে সরবরাহ ৩৬ লাখ টনের মতো। অন্যদিকে চাহিদা ২৪ লাখ টনের মতো। অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত খরচ ২০ শতাংশ বাদ দিতে হবে। তারপরও ২৯ লাখ টন পেঁয়াজের সরবরাহ থাকে।

তাহলে পেঁয়াজ গেল কোথায়, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ফরিদপুরের ব্যবসায়ীদের মন্তব্যে। ফরিদপুরের হাজি শরীয়তুল্লাহ বাজারের মেসার্স কবিরাজ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিন্টু কবিরাজ বলেন, গত মৌসুমে পেঁয়াজ তোলার ১৫ দিন আগে সালথা ও নগরকান্দায় শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। এতে অন্তত ৭৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। উৎপাদনের হিসাবে যা আসেনি।

অবশ্য ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, কৃষি বিভাগ পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়িয়ে বলেনি। তবে বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় কৃষক তা মজুত না করে আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে মৌসুমের সময় পেঁয়াজের কেজি ২ থেকে ৩ টাকায় নেমেছিল।

সরকার পেঁয়াজের সংকট আঁচ করতে পেরেছিল কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুঝতে পেরেছিলাম বলেই বিমানে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে সারা দেশে পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে। বিমানে পেঁয়াজের একটি চালান মঙ্গলবারে আসবে। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে আরও আসবে। নতুন পেঁয়াজ উঠছে। আশা করছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্যামবাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, মিয়ানমারের পেঁয়াজ শেষের পথে। এখন দাম নির্ভর করছে অন্য দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেঁয়াজ আসছে কি না, তার ওপর। 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়, ফরিদপুর ও পাবনা প্রতিনিধি।)