বিশ্ব প্রবৃদ্ধির হালচাল

বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। এমনকি পাঁচ বছর পরেও বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান থাকবে বাংলাদেশের। নানা অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বের অনেক দেশই হয়তো এ তালিকা থেকে ছিটকে যাবে, কিন্তু নিজের অবস্থান ধরে রাখবে বাংলাদেশ।

২০১৯ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে (ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার ভিত্তিতে) বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। পাঁচ বছর পরে এই অবদান হবে শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ। শুধু তা–ই নয়, চলতি বছরে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি তৃতীয় সর্বোচ্চ—৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের’ প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্ব প্রবৃদ্ধির অবদানে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসবে ভারত।

তবে মজার বিষয় হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি একটা চক্রের মতো। এই চক্র বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া যায়। ২০১৯ সালে বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ ২০ অর্থনীতির অংশ হবে ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা কমে হবে সাড়ে ৭৮ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে ২০টি দেশের তালিকার পুনর্বিন্যাস হবে। কিছু দেশ তালিকার ওপরের সারিতে চলে আসবে, আবার বড় অর্থনীতির কিছু দেশ নিচের দিকে নেমে যাবে। যেমন বলা যায়, ২০১৯ সালে এই ২০ দেশের তালিকায় আছে স্পেন, পোল্যান্ড, কানাডা ও ভিয়েতনাম। পাঁচ বছর পর এদের সরিয়ে তালিকায় চলে আসতে পারে তুরস্ক, মেক্সিকো, পাকিস্তান, সৌদি আরব। আবার বর্তমানে বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যে অবদান, আগামী পাঁচ বছর অবদানের অংশ এতটা না–ও থাকতে পারে।

অথচ কয়েক বছর আগেও বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা ছিল ভিন্ন। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল দেশগুলো। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার ছিল আশানুরূপ। তবে পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। এসব দেশের প্রবৃদ্ধি কমছে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিও চলছে ধীরগতিতে। দেশগুলোর মধ্যে চলছে বাণিজ্য সংঘাত, আছে ব্রেক্সিটজনিত অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষ এই দেশগুলোর অবদানও কমে যাচ্ছে।

আইএমএফ বলছে, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ হবে। এর ফলে আগামী এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতির প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করতে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। এ নিয়ে মোট পাঁচবার চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাল বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি। অর্থাৎ বাণিজ্যযুদ্ধ ও ব্রেক্সিটের মতো বিষয়গুলো যত জটিল হচ্ছে, অর্থনীতির গতি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কাও তত বাড়ছে।

১৮৭১ সাল থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি দখল যুক্তরাষ্ট্রের। ২০১৮ সালে দেশটির অর্থনীতির আকার ছিল ২০ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আইএমএফ বলছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে আড়াই শতাংশ; যা গত বছর ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে ৯ দশমিক ২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। ভারতের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে ভারতের অংশ বেড়ে হবে সাড়ে ১৫ শতাংশ।

আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে দুটি দেশের অর্থনৈতিক গতিই শ্লথ হয়ে পড়ছে। চীনের অর্থনীতিতে ফাটল ধরেছে—এমনটা এখন পরিসংখ্যানই বলছে। যেমন গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে চীনের প্রবৃদ্ধির হার ৬.৬ শতাংশ—যা গত ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে কমছে প্রবৃদ্ধির হার। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে চীনের অংশ ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ থাকবে। তবে ২০২৪ সাল নাগাদ তা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ২৮.৩ শতাংশে নেমে আসবে।

সবচেয়ে নিরাশাজনক অবস্থা যুক্তরাজ্যের। পাঁচ বছর পর বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ৯ থেকে নেমে ১৩–তে চলে যাবে। এখনো স্থিতিশীল হলেও রাশিয়ার অবস্থাও নাজুক। বর্তমানে ৫ নম্বরে থাকা জাপান নেমে আসবে ৯ নম্বরে। তবে বাড়বে ব্রাজিল ও জার্মানির অংশ। জার্মানি ১১ নম্বর অবস্থান থেকে উঠে ৬ নম্বরে আসবে।

আইএমএফ বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্ব প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা শীর্ষ ২০ দেশ হবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, মিসর, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, বাংলাদেশ, স্পেন, পোল্যান্ড, কানাডা ও ভিয়েতনাম। ২০২৪ সালে এই তালিকায় থাকবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, মিসর, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, বাংলাদেশ, তুরস্ক, মেক্সিকো, পাকিস্তান, সৌদি আরব।

১৯৬০ সাল থেকে সারা বিশ্বের সব দেশের জিডিপি এক করে বিশ্ব প্রবৃদ্ধি নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব অর্থনীতি এখন প্রায় ৮৬ ট্রিলিয়ন ডলারের (এক ট্রিলিয়ন হচ্ছে ১ হাজার বিলিয়ন। আর এক বিলিয়ন হচ্ছে ১০০ কোটি)। বিশ্বব্যাংকের তথ্য ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এশিয়া অঞ্চলের অবদান সবচেয়ে বেশি, ৩৫ শতাংশ, উত্তর আমেরিকার অবদান ২৬ দশমিক ১১ শতাংশ, ইউরোপের অবদান ২৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ল্যাটিন আমেরিকার অবদান ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও আফ্রিকার অবদান ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

২০২৪: কোথা থেকে আসবে বিশ্ব প্রবৃদ্ধি

বিশ্ব প্রবৃদ্ধির ৭৮.৫ শতাংশ আসবে যে ২০টি দেশ থেকে

চীন ২৮.৩%

ভারত ১৫.৫%

যুক্তরাষ্ট্র ৯.২%

ব্রাজিল ১.৮%

জার্মানি ১.৬%

তুরস্ক ১.৬%

ইন্দোনেশিয়া ৩.৭%

জাপান ১.৬%

মেক্সিকো

যুক্তরাজ্য

ফিলিপাইন

মিশর ১.৫%

ফ্রান্স

পাকিস্তান

সোদি

আরব

রাশিয়া ২.০%

দ. কোরিয়া

বাংলাদেশ ০.৭১%

মালয়েশিয়া

থাইল্যান্ড

অন্যান্য দেশ ২১.৫%

* ১০টি দেশের অবদান ১ শতাংশের কম

সূত্র: আইএমএফ–এর তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্লুমবার্গ