দাম বেড়েছে চালের, লাভ নেই কৃষকের

চালের ছবিটি প্রতীকী।
চালের ছবিটি প্রতীকী।

দেশে চালের দাম বেড়েছে। বাড়তি ধানের দামও। কিন্তু এমন সময়ে দাম বাড়ল, যখন প্রান্তিক কৃষকের কাছে ধান নেই। ফলে এই মূল্যবৃদ্ধির সুবিধাভোগী মূলত মিলমালিক, আড়তদার ও বড় কৃষকেরা। আর বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

ঢাকার পাইকারি বাজারে গত ১৫ দিনে সরু মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বৃদ্ধির কথা জানান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে মাঝারি বিআর-২৮ ও সমজাতীয় চালের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। মোটা চালের দাম তুলনামূলক কম বেড়েছে, কেজিপ্রতি ২ টাকার মতো। 

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, পুরান ঢাকার বাবুবাজার-বাদামতলী ও কারওয়ান বাজারের চালের আড়তে বিভিন্ন মিলের মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ চাল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৬ টাকা দরে। আর মোটা স্বর্ণাজাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে ২৭-২৮ টাকা কেজি দরে। 

পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে খুচরায়। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, কাজীপাড়া, তেজগাঁও ও কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানে মিনিকেট ৪৮, ৫০ ও ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। বিআর-২৮ জাতের চাল উঠেছে ৩৬, ৩৮ ও ৪০ টাকায়। আর মোটা চাল তাঁরা ৩২ থেকে ৩৪ টাকা চাইছেন।

পাইকারি বাজারে ধান কম
নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুরের মিল ও চালের বাজার ঘুরে প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা জানান, সেখানেও চালের দাম বেড়েছে। পাশাপাশি ধানের দাম জাতভেদে মণপ্রতি ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণ পাইকারি বাজারে ধানের সরবরাহ কম। এর মানে হলো, সাধারণ কৃষকের কাছে তেমন ধান নেই।

সরকারি হিসাবে, গত বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় ২ কোটি ৪ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৮ লাখ টন বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সব মিলিয়ে চাল উৎপাদিত হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চাল ৪৪ লাখ টন উদ্বৃত্ত আছে। 

বাড়তি উৎপাদনের কারণে গত আমন ও বোরোতে ধানের দাম পায়নি কৃষক। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বোরোতে প্রতি মণ চাল (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) উৎপাদনে কৃষকের গড় খরচ হয়েছে ৯১৪ টাকা। মৌসুমের সময় বাজারে ধানের ধাম মণপ্রতি ৫০০ টাকার আশপাশে ছিল। এখন নওগাঁয় মোটা ধান মণপ্রতি ৭১০ থেকে ৭২০ টাকা ও সরু ধান ৯৪০-৯৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কুষ্টিয়ায় মিলের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, তারা ১ নভেম্বর সরু ধান কিনেছে মণপ্রতি ৯৩০ টাকা দরে। গত বৃহস্পতিবার একই ধান তারা কিনেছে ১ হাজার ৮০ টাকা দরে। 

চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ধানের দাম বাড়াকে দায়ী করছেন মিলমালিকেরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতি কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার গত ৩১ অক্টোবর ধান কেনার বড় ঘোষণা (৬ লাখ টন) দেওয়ার পর থেকে ধানের দাম বেড়ে যায়। এই এক কারণেই চালের দাম বেড়েছে।’

অবশ্য কৃষকেরা বলছেন, তাঁদের কোনো লাভ নেই। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের পালশার কৃষক রফিকুল ইসলাম গত বোরো মৌসুমে তিন একর জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। আড়াই শ মণের মতো হয়েছিল। তিনি বলেন, ধান ওঠার পর বিক্রি করে দায়-দেনা মিটিয়েছেন। এলাকার অন্যান্য কৃষকেরও একই অবস্থা। 

এখন ধানের মূল্যবৃদ্ধির কথা শুনেছেন উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, এখন বাড়লেও তাঁর মতো কৃষকেরা কোনো সুফল পাবেন না। 

উদ্যোগে কাজ হয়নি
মৌসুমের সময় ধানের দাম বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। বোরোতে সরকারিভাবে সংগ্রহে চালের দাম ২ টাকা বাড়িয়ে ৩৬ টাকা করা হয়। আবার রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু ধানের দাম তখন বাড়েনি। 

চাল রপ্তানি নিয়েও দ্বিধায় পড়েছে সরকার। গত ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (রপ্তানি) সভাপতিত্বে চাল রপ্তানি ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত সরকার ৬৬ হাজার টন চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। 

সভায় কৃষি মন্ত্রণালয় রপ্তানির পক্ষে মত দিলেও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, এটি আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। কারণ, ভোগ ও উৎপাদন হিসাব করলে দেখা যায়, খুব বেশি উদ্বৃত্ত থাকে না। রপ্তানিতে ভর্তুকি দিলে তার সুফল কৃষকেরা পাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি। 

সভায় ট্যারিফ কমিশনকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়। অবশ্য সেই প্রতিবেদন এখনো জমা পড়েনি বলে জানা গেছে। 

আমদানি প্রায় বন্ধ
বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম তুলনামূলক কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত থেকে মোটা চাল আমদানি করলে প্রতি কেজির দাম পড়বে ৩৪ টাকার কম। আর থাইল্যান্ড থেকে আনলে পড়বে কেজিপ্রতি ৩৮ টাকার কিছু বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মাত্র ৪০ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। 

১১ নভেম্বরের হিসাবে, সরকারি খাদ্যগুদামে ১১ লাখ ৪৬ হাজার টন চাল মজুত ছিল। 

২০১৭ সালে হাওরে আগাম পানি চলে আসা ও অতিবৃষ্টিতে উৎপাদন কম হয়। তখন সরকার দুই দফায় চাল আমদানি বাড়াতে মোট করভার কমিয়ে ২৮ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। গত মে মাসে চাল আমদানির শুল্ক বাড়িয়ে মোট করভার ৫৫ শতাংশ করা হয়। 

অবশ্য কৃষকেরা তেমন কোনো সুফল পাননি। এবার আমন মৌসুমে ধান কেনার পরিমাণ বাড়াবে সরকার। ২৬ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পায়। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এস এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন ধানের দাম বাড়লেও কৃষকের জন্য তা তাৎপর্য তৈরি করে না। তবে এ দামটি যদি আসছে আমন মৌসুমে টিকে থাকে, তাহলে কৃষক কিছুটা সুফল পাবে। বাজার চালের পাশাপাশি ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা মানুষের ওপর চাপ তৈরি করবে। পেঁয়াজের সাময়িক মূল্যবৃদ্ধি মানুষ মানিয়ে নিতে পারত। কিন্তু আরও অনেক কিছুর দাম বেড়ে গেলে কিছু করার থাকে না। তিনি উল্লেখ করেন, কিছুদিন পরেই মৌসুম শুরু হলে পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম কমে যাবে।   

(প্রতিবেদনটি লিখতে প্রথম আলোর কুষ্টিয়া প্রতিনিধি তৌহিদী হাসান, নওগাঁ প্রতিনিধি ওমর ফারুক ও দিনাজপুর প্রতিনিধি সহায়তা করেছেন।)