বাণিজ্যের হাত ধরেই নতুন যুগের সূচনা

মানুষ প্রথম বাণিজ্য শুরু করেছিল পণ্য বিনিময় প্রথার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় মূল্যবান ধাতব মুদ্রা। এই প্রক্রিয়ায় প্রাচীন পৃথিবী অনেক দিন চলেছে। পরিবর্তনটা আসতে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। এই সময়ে ইউরোপে নগররাষ্ট্র গড়ে উঠতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধিশালী বণিক শ্রেণি গড়ে ওঠে।

এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বণিক শ্রেণির উত্থান ইউরোপজুড়ে এক সামাজিক পরিবর্তন সূচিত করে। এই বণিকদের সঙ্গে তখন ব্যাংকের গাঁটছড়া গড়ে ওঠে। ব্যাংকও তখন বাণিজ্য ও বণিকদের সমুদ্রযাত্রায় অর্থায়ন করতে শুরু করে। ফলে ছোট ছোট সামন্তীয় অর্থনীতির জায়গা নিতে শুরু করে বণিক অর্থনীতি।

এই পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনীতির ধারণা বা চিন্তায়ও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য ও টাকার বিনিময় কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেটাই তখন অর্থনীতির ভাবনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময়ের প্রধান ধারাটি ছিল মার্কেন্টিলিজম বা বাণিজ্যতন্ত্র ব্যালেন্স অব পেমেন্ট। এটা হলো, একটি দেশ আমদানিতে যে পরিমাণ ব্যয় করে এবং রপ্তানিতে যে পরিমাণ আয় করে, সেই দুটি সংখ্যার পার্থক্য। অন্য দেশের কাছে পণ্য রপ্তানি করাটা স্বাভাবিকভাবেই ভালো চোখে দেখা হতো, কারণ এতে টাকা আসে। কিন্তু আমদানিতে যেহেতু টাকা বেরিয়ে যেত, সেহেতু লোকে মনে করত, আমদানি ক্ষতিকর। আর সেখান থেকেই বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের জন্ম।

বাণিজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে তা ব্যক্তি বণিকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যায়। একটা সময় অংশীদার ও কোম্পানি গঠিত হতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারও এতে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। বড় বড় বাণিজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে এসব গড়ে ওঠে। এরপর এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার ভাগ হতে থাকে। এতে ব্যক্তি অর্থায়নের জায়গায় সামষ্টিক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৭ শতকের দিকে শেয়ার কেনা লাভজনক হতে শুরু করে এবং স্টক এক্সচেঞ্জ ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানির জন্ম হয়।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কাছে অর্থনীতি ছিল নৈতিক দর্শন। অর্থনীতির কীভাবে কাজ করা উচিত, সেই তত্ত্ব তাঁরা দিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবে কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের সময়ের দার্শনিকেরা ভাবেননি। এটা একরকম আদর্শ স্থাপনকারী চিন্তা, ইংরেজিতে যাকে বলে নরম্যাটিভ। ব্যাপারটা অত্যন্ত ব্যক্তিমতনির্ভর। কী হওয়া উচিত, এই চিন্তার পরিসর ছিল তা নিয়ে।

কিন্তু ১৭ শতকে এসে ব্যাপারটা পাল্টে গেল। বাণিজ্যের পরিসর বাড়ার কারণে অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে নতুন চিন্তার উদয় হয়। এখান থেকেই অর্থশাস্ত্রের জন্ম। ১৮ শতকের শুরুতে আলোকায়নের  শুরু। এর প্রবক্তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে যুক্তি বৃদ্ধিকে স্থান দেন। ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির’ ব্যাপারে তাঁরা বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি গ্রহণ করেন। অর্থনীতিবিদেরা তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বোঝার চেষ্টা করেন। এই ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা অনুসন্ধান করেন। ফলে অর্থনীতি আর নৈতিক সীমায় আটকে থাকল না।

এই সময় ফ্রান্সে একজন চিন্তক অর্থপ্রবাহ পরিমাপ করেন। এঁরাই প্রথম সামষ্টিক অর্থনীতির ধারণা তৈরি করেন। তাঁরা অবশ্য বাণিজ্য বা অর্থব্যবস্থা নয়, কৃষিকে অর্থনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ দার্শনিকেরা বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে উৎপাদক, ভোক্তা বা পণ্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেন। এখান থেকেই অর্থনীতির আধুনিক চিন্তার সূত্রপাত।