দারিদ্র্য বিমোচনে শীর্ষ ১৫ দেশে নেই বাংলাদেশ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্য তুলে ধরতে ঢাকায় একটি শোকেসের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। তাতে অংশ নিতে তৎকালীন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশে আসেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে গত কয়েক দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরা হয়। 

তিন বছর পরে এসে এখন বিশ্বব্যাংকই বলছে, গত দেড় দশকে দ্রুত দারিদ্র্য কমানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। ওই ১৫টি দেশ যে গতিতে দারিদ্র্য কমিয়েছে, বাংলাদেশে কমেছে এর চেয়ে কম। 

১২ নভেম্বর বিশ্বব্যাংক এমন তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বাদ পড়েছে। কারণ, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে। 

২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত অতিদারিদ্র্য কমিয়েছে এমন শীর্ষ ১৫ দেশের তালিকায় আছে তানজানিয়া, তাজিকিস্তান, চাদ, কঙ্গো, কিরগিজস্তান, চীন, ভারত, মালদোভা, বারকিনো ফাসো, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, পাকিস্তান ও নামিবিয়া। এসব দেশে মোট ৮০ কোটি মানুষ ওই দেড় দশকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি ৩ দশমিক ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমিয়েছে তানজানিয়া। দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ৮৬ শতাংশ থেকে কমে ৪৯ শতাংশে নেমেছে। আর ১৫ নম্বরে থাকা নামিবিয়া ১ দশমিক ৬ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমিয়েছে। বাংলাদেশে কমেছে ১ দশমিক ৪২ শতাংশ হারে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশে এখনো সোয়া ২ কোটি হতদরিদ্র লোক আছে। 

>
  • দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি, ৩. ২% হারে দারিদ্র্য কমিয়েছে তানজানিয়া
  • বাংলাদেশ কমিয়েছে ১.৪২% হারে
  • বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান

ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করলেই ওই ব্যক্তিকে আর গরিব হিসেবে ধরা হয় না। এটি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে স্বীকৃত। এর বাইরে প্রতিটি দেশের একটি জাতীয় দারিদ্র্যরেখা আছে। ২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ। 

কেন বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালের পর দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমেছে। কিন্তু ওই সময়ের পরে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়—দুটোই বেড়েছে। এই চিত্র দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমার হিসাবের সঙ্গে মিলছে না। কোথাও কোনো পরিসংখ্যানগত অসংগতি থাকতে পারে। 

জাহিদ হোসেনের মতে, আগে শিল্প ও আবাসন খাতে শ্রমঘন কর্মসংস্থান হয়েছে, মজুরি বেড়েছে। কিন্তু ইদানীং শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি আগের মতো শ্রমঘন নয়। তাই কর্মসংস্থান আর মজুরিও আগের মতো বাড়েনি। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির সুফল তুলনামূলক বেশি পেয়েছেন উদ্যোক্তারা, যা বৈষম্য বাড়িয়েছে। 

অন্যরা বেশি এগিয়ে যাচ্ছে
২০০০ সালের দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনামে অতিদারিদ্র্যের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল। যদিও এসব দেশের অতিদরিদ্রদের জীবনমান তখনো বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু দারিদ্র্য ঘোচানোর প্রতিযোগিতায় এসব দেশ গত দেড় দশকে অনেক এগিয়েছে। তারা দারিদ্র্যের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়েছে। চীন ওই ১৫ বছরে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। দেশটির প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় দারিদ্র্যের হার ৩৭ থেকে ৭ শতাংশ হয়েছে। দেশটিতে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। এমন মানুষের সংখ্যা ভিয়েতনামে আড়াই কোটি ও পাকিস্তানে ৩ কোটি ৩৮ লাখ। ভারত ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্যের হার ৩৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২১ শতাংশে নামিয়েছে। দেশটিতে গরিব মানুষ কমেছে ১৬ কোটির বেশি।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। একটি দেশের উন্নয়নের পথযাত্রায় ধনীরা আগে সম্পদ তৈরি করে। এ সময় গরিবদের সম্পদ তৈরির সুযোগ তুলনামূলক কম থাকে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনে কিছুটা ভাটা পড়ে। তাঁর মতে, এই অবস্থার উত্তরণে বর্তমান সরকার মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জোর দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় যখন দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ধীর হয়েছিল, তখন ওই দুটি দেশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করেছিল। এতে তারা সফলও হয়েছে।

বাংলাদেশে বৈষম্য প্রবল
২০০০-২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গরিবের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ লাখের বেশি। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে এ দেশে প্রায় অর্ধেক মানুষই হতদরিদ্র ছিল। তখন হতদারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। এখন তা ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের এই সাফল্য বিশ্বনন্দিত। 

কিন্তু বাংলাদেশে বৈষম্য প্রবল। এ দেশে সবচেয়ে গরিব প্রায় পৌনে ২০ লাখ পরিবারের প্রতি মাসে গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকা। তারা হলো দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবার। একইভাবে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। এমন ১৯ লাখ ৬৫ হাজার পরিবারের প্রতি মাসে গড় আয় ৮৯ হাজার টাকা। এর মানে হলো, দেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবারের চেয়ে সবচেয়ে ধনীরা প্রায় ১১৯ গুণ বেশি আয় করেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।