দক্ষতার অভাবেই বেকারত্ব বাড়ছে

নেত্রকোনার তরুণী কামরুন নাহার আজ থেকে ছয় বছর আগে বাবাকে হারিয়ে সংসারের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাঁর দুরবস্থা দেখে এক শিক্ষক তাঁকে কারিগরি প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানে কম্পিউটার পরিচালনা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁর জীবন বদলে গেল। বিশ্বব্যাংকের এক ব্লগপোস্টে সংস্থাটির পরামর্শক মুসতাসিন উল আজিজ এই তথ্য দিয়েছেন।

বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-২০১৯-এ বলা হয়েছে, প্রযুক্তি মানুষের কাজের নতুন নতুন দুয়ার খুলে দেবে, যার কথা মানুষ আগে ভাবতেও পারেনি। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় দক্ষতা। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে তার নজির দেখা যাচ্ছে। ফ্রিল্যান্স প্রোগ্রামিং ও ডিজাইনিংয়ের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ারিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো সেবা প্রযুক্তির কারণে সম্ভব হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ারিং বা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে কাজ করার জন্য উচ্চ দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এসব আবার সম্ভব হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি—এই খবর এখন সবাই জানে। শ্রম জরিপ অনুসারে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পাস করা তরুণদের বেকারত্বের হার যথাক্রমে ৩৯ ও ৪৬ শতাংশ। আর পলিটেকনিক কলেজ থেকে পাস করাদের বেলায় তা ৩২ শতাংশ।

তবে এই বেকারত্বের জন্য বাজারে চাকরির অভাব যত না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব। প্রতিবেদকের কাছে অনেক নিয়োগদাতাই বলেছেন, বাজারে যোগ্য মানুষের বড়ই অভাব। এখানে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক আছে। ব্যবসায়ী ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান প্রতিবেদককে সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘আমার অফিসে বা করপোরেট জগতে দক্ষ ব্যক্তিগত সহকারীর অভাব আছে। এই কাজের জন্য উচ্চ দক্ষতার প্রয়োজন নেই। ইংরেজি ও বাংলায় যোগাযোগ দক্ষতা এবং কম্পিউটারের সাধারণ দক্ষতা থাকলেই এই কাজ করা সম্ভব। এর জন্য আমি ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে পারি। কিন্তু এ রকম লোকও পাওয়া যায় না।’

এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ব্লগপোস্টে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষণপদ্ধতির উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি খাতের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও অংশীজনদের মধ্যে আরও সমন্বয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সফটি স্কিল বা আন্তব্যক্তিক দক্ষতা অর্জনে জোর দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ইত্যাদি। আগামী দিনে নিয়োগদাতারা প্রার্থীদের মধ্যে এসব গুণ দেখতে চাইবেন বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে কোন কোন গুণ দেখতে চান, এমন প্রশ্নের জবাবে সহজ লিমিটেডর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনয় ও শেখার আগ্রহ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম ও দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে সৃজনশীল ও বিশ্লেষণী চিন্তার দক্ষতা।’

আন্তব্যক্তিক দক্ষতার প্রসঙ্গে শিক্ষণের সম্পর্ক আছে। বিশ্বব্যাংকের এই ব্লগপোস্টে মুসতাসিন উল আজিজ বলেন, আন্তব্যক্তিক দক্ষতা থাকলে মানুষ সহজে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং তা থেকে জীবনব্যাপী শিক্ষণের মানসিকতা তৈরি হয়। আর এই দক্ষতার প্রশিক্ষণ অর্থনৈতিক রূপান্তরে ভূমিকা পালন করে।

দক্ষতার ঘাটতি পূরণে অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংক স্কিলস অ্যান্ড ট্রেইনিং এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট সে রকম এক অংশীদারির নজির। এই প্রকল্পের সঙ্গে বিজিএমইএর এক অংশীদারির মাধ্যমে ১১ হাজার অদক্ষ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণের পর ৮০ শতাংশ কর্মী চাকরি পান। কারিকুলাম প্রণয়ন, ইন্টার্নশিপ, ল্যাবরেটরি/কর্মশালা—এসব ক্ষেত্রে অংশীদারি থাকলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে ব্লগপোস্টে মন্তব্য করা হয়েছে।

কামরুন নাহার এখন বড় স্বপ্ন দেখেন। চাকরি করা নয়, অন্যকে চাকরি দিতে চান তিনি। এখন তিনি প্রোগ্রামিংয়ের ফার্ম খুলতে চান। সেখানে পিতৃ-মাতৃহীন মেয়েদের কাজ দিতে চান তিনি।
চাকরির বাজার পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। এ জন্য তরুণদের সঠিক দক্ষতা অর্জনে জোর দিতে হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।