মেটালের কাজ আধুনিক কৃষি খাত নিয়েই

মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল
মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল

বাংলাদেশের কৃষিকাজের সঙ্গে যাঁদের একটু হলেও যোগাযোগ বা পরিচয় আছে, ট্যাফে ট্রাক্টরের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। ১৯৯৩ সালে কৃষির যান্ত্রিকীকরণও শুরু হয়েছিল এই ট্যাফে ট্রাক্টরের মাধ্যমে। এখন জমি চাষে যন্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে ফসল কাটা ও রোপণেও। এই ট্যাফে ট্রাক্টর দেশে এনেছিল দ্য মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড।

১৯৮৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা মেটাল এখন গ্রুপ প্রতিষ্ঠান। কৃষি আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণে জড়িত গ্রুপটির ১৩ প্রতিষ্ঠান। শুরুতে ট্রাক্টর বিক্রি করলেও এখন কৃষিযন্ত্র তৈরি ও আমদানি, বীজ উৎপাদন, অটোমোবাইল, মোবাইলের টাওয়ার নির্মাণও পরিচালনাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত মেটাল। বছরে গ্রুপটির টার্নওভার (বিক্রি) প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে গ্রুপটি পণ্যও সেবা বিক্রি ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে চায়। মেটালের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল।

মেটালের উত্থানের গল্প শুনতে গত বুধবার সাদিদ জামিলের কাছে গিয়েছিলাম। গুলশানে মেটালের নিজস্ব অফিস। নিজের জন্য আলাদা কোনো কক্ষ নেই। অতিথিদের জন্য আলোচনার কক্ষটিই তাঁর বসার জায়গা।

প্রকৌশলী বাবার প্রকৌশলী সন্তান

সাদিদ জামিলের জন্ম ঢাকার নারিন্দায়। বাবার চাকরি সূত্রে বেড়ে উঠেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পরবর্তী সময়ে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। ১৯৮৩ সালে পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনে (বিসিআইসি), সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। তবে চাকরি শুরুর দিন থেকে নতুন কিছু করার তাড়না কাজ করছিল।

সাদিদ জামিলের বাবা জামিল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। ১৯৮০ সালে অবসরে যান। সাদিদ জামিল বলেন, ‘বাবা বলেছিলেন, হয় চাকরি নয় ব্যবসা। দুটো একসঙ্গে নয়। তাই চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করি।’

চাকরির ফাঁকে ব্যবসার চেষ্টা

সাদিদ জামিল বিসিআইসিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিলেও পদায়ন হয় বাংলাদেশ ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেডে (বিআইএসএফ)। রাজধানীর চিড়িয়াখানা রোডে বিআইএসএফ তখন এককভাবে বাথরুম ফিটিংস তৈরি করত। ব্যবসার চিন্তা থেকেই দুপুরের পরের সময়টাকে কাজে লাগাতে সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটার শিফটে কাজ শুরু করেন।

সাদিদ জামিলের ভাষায়, ‘ভোর পাঁচটায় গাড়ি নিতে আসত। চারটায় ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুতি নিতে হতো। সময়টা আমার জন্য বেশ কষ্টের ছিল।’

দুপুরের পরের সময়ে অনেক ধরনের ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাদিদ জামিল। প্রথম দিকে টমেটোর সস বানিয়ে বিক্রি করেছেন। ব্যর্থ হয়ে ঋণ নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে দুটি বাস ছেড়েছেন, তাতেও সফল হননি। আবার ওয়ার্কশপ খুলে নিজের জগতেও ফিরে যেতে চেয়েছেন। তাও হয়নি। এমনকি ভারত থেকে বাস-ট্রাকের চেসিস এনে কাঠামো প্রস্তুত করেছেন। তবে হঠাৎ করে ভারতের ওই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যবসায়ও ধরা খেলেন সাদিদ জামিল।

যেভাবে মেটাল

এবার চাষের জন্য ট্রাক্টর আমদানির চিন্তা করলেন। তবে ছেলেকে এবার একা ছেড়ে দিতে চাননি বাবা জামিল উদ্দিন আহমেদ। পরিচয় করে দেন প্রজেক্ট বিল্ডার্সের কর্ণধার প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। একেবারে শূন্য হাতে সাদিদ জামিল তাঁর কাছে যান। এর মধ্যে চাকরিও ছেড়ে দেন। ১৯৮৭ সালে গড়ে তোলেন মেটাল। আমিনুল ইসলাম চেয়ারম্যান ও সাদিদ জামিল ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সাদিদ জামিল বলেন, ‘আমি আমিনুল ইসলামকে বলেছিলাম, ১০ লাখ টাকা হলেই ব্যবসা করতে পারব। আসলে কত টাকা যে লেগেছে তার কোনো হিসাব নেই। শুরুতে সবই উনি দিয়েছেন।’

মেটালের শুরুতে আবারও বাসের কাঠামো তৈরি করা শুরু করে। তবে ট্রাক্টর আমদানির চিন্তা থেকে সরে আসেননি। ১৯৯৩ সালে কাঠামো তৈরি বন্ধ করে শুরু করেন ট্যাফে কৃষি ট্রাক্টর আমদানি। ওই বছরে ট্রাক্টর বিক্রি হয় পাঁচটি। আর ২০১৮ সালে এসে সেই ট্যাফে ট্রাক্টরের বিক্রি দাঁড়ায় তিন হাজার।

সাদিদ জামিল বলেন, ‘বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে মেটালই প্রথম ট্রাক্টর নিয়ে আসে। এর আগে চিনিকল ও চা–বাগানে ট্রাক্টরের ব্যবহার ছিল। এখন প্রতিবছর প্রায় ৯ হাজার ট্রাক্টর বিক্রি হচ্ছে।’

ডানা মেলল মেটাল

মেটাল শুধু ট্রাক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়নি। নিয়ে আসে ফসল কাটা, ধান রোপণ, ধান মাড়াইসহ নানা কৃষি যন্ত্রপাতি। ২০০২ সাল থেকে সবজি, ধান, আলুর বীজ উৎপাদন শুরু করে। এখন ফুলের বীজও উৎপাদন করছে।

গবেষণাও বীজ উন্নয়নের জন্য রয়েছে মেটালের নিজস্ব সেন্টার। এ সেন্টারে সবজির প্রায় ৪০টি জাত উন্নয়ন করেছে। এখন ধানের হাইব্রিড বীজও করছে। আবার ওয়ার্কশপও রয়েছে। যেখানে ইউরিয়া দেওয়া, ধান মাড়াই, আলু ওঠানো, পাট থেকে আঁশ ছাড়ানোর যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকার যন্ত্র বিক্রি হয় মেটালের ওয়ার্কশপের।

সাদিদ জামিল বলেন, ‘এটা আরও বড় করার সুযোগ আছে। বাজারও আছে। আমরা ভাবছি।’

এখন চীন থেকে বড় আকারের ট্রাক ও ভারত থেকে অতুলের থ্রি–হুইলার (ডিজেল, সিএনজি ও এলপিজিচালিত) আনছে মেটাল। এখন কৃষির পাশাপাশি অটোমোবাইল খাতে মনোযোগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে বড় প্রবৃদ্ধির আশা করছে। তিনি জানান, মেটালের বীজ প্রস্তুত হয় গাজীপুরের শালনাতে। গবেষণাও উন্নয়ন খামার রয়েছে পঞ্চগড়ে। সারা দেশে ট্যাফে ও আইশার ট্রাক্টর বিক্রির জন্য ৪০টি এলাকায় শোরুম আছে।

সাদিদ জামিল বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে ২০০০ সালের পর। ওই সময়ে ট্রাক্টর ও বীজের বাজার বড় হয়। আমরাও ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করি।’

ব্যাংক যখন বন্ধু

ব্যবসা করতে গিয়ে খুব বড় সমস্যায় পড়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না সাদিদ জামিল। তবে বাকিতে ব্যবসা করেন, এ জন্য ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সমস্যায় পড়েন। যদিও কিস্তি পরিশোধে বিলম্ব করেন না। বেসরকারি খাতের পূবালী, ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণ রয়েছে।

সাদিদ জামিল বলেন, ‘ব্যাংক সব সময় আমাকে সহায়তা করেছে। বন্ধুর মতো ভূমিকা রেখেছে। আমিও কখনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। এটাকে আমি জীবনের বড় অর্জন মনে করি।’

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, ‘আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে মেটালের ভূমিকা অনেক। দেশের কৃষি খাতে প্রতিষ্ঠানটি অবদান রাখছে। আমাদের ব্যাংকের সঙ্গে তাদের লেনদেনও ভালো।’

পরিবার

সাদিদ জামিল ও উর্মী সাদিদ দম্পতির এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে সারাহ জামিল ও ছেলে সাদ আহমেদ জামিল পড়াশোনা শেষে কানাডাতেই চাকরি করছেন। সাদিদ জামিল বললেন, ‘তাদের বলেছি, চাইলে দেশে এসে ব্যবসার হাল ধরতে। তাদের মন চাইলে আসবে। আমি জোর করব না।’

সাদিদ জামিল বলেন, ‘কর্মীরা প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মনে না করলে ব্যবসা করা কঠিন। আমাদের কর্মীরা নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে। এভাবেই চলুক, এটাই আমার চাওয়া। মেটালের সব কর্মীরাই আমার পরিবারের অংশ।’

আলোচনা শেষে জানতে চেয়েছিলাম, আপনি কি নিজেকে সফল মনে করেন? সাদিদ জামিলের সহজ জবাব, ‘পুরোপুরি সফল হয়েছি, তা মনে করি না। তবে চাকরি করে যা হতে পারতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে পেরেছি। ১ হাজার ৭০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার কৃষির সঙ্গে জড়িত। এসবই আমাকে প্রশান্তি দেয়। সব সময় মনে হয়, চাকরি ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তটি ভালো ছিল।’

একনজরে মেটাল

প্রতিষ্ঠা: ১৯৮৭

বছরে বিক্রি: ৬০০ কোটি টাকা

প্রতিষ্ঠান: ১৩টি

কর্মী: ১ হাজার ৭৫৩ জন

পণ্য: ট্যাফেও আইশার ট্রাক্টরের পরিবেশক

বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদক বিক্রি হয় সারা দেশে

নতুনদের জন্য পরামর্শ

বাংলাদেশে এখন ব্যবসা করার অফুরন্ত সুযোগ। আগ্রহ ও সৎভাবে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

সরকারের কাছে চাওয়া

কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কৃষকেরা কোনো ঋণ পান না। ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফসল কাটার যন্ত্রপাতি কিনতে সরকার ভর্তুকি দেওয়া শুরু করেছে, এটা যেন অব্যাহত থাকে। কারণ, এসব যন্ত্রের সারা বছর ব্যবহার থাকে না। আর কৃষি খাতে মুনাফা খুবই কম। তাই করপোরেট কর ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনলে ভালো হয়।