গোপনে চাকরি ছেড়ে ডেটা কারবারে

সহকর্মীদের নিয়ে ক্র্যামস্ট্যাকের উদ্যোক্তা নাজমুস সাকিব
সহকর্মীদের নিয়ে ক্র্যামস্ট্যাকের উদ্যোক্তা নাজমুস সাকিব

নিজের ব্যবসা চালু করতে ভালো পদের চাকরি ছাড়তে সাহস পান না অনেকেই। পারিবারিক চাপের কারণে অনেকেই বলতে পারেন না নিজের ভালো লাগার কথা। কিন্তু পেরেছেন ক্র্যামস্ট্যাকের উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুস সাকিব। তথ্য-উপাত্ত বা ডেটা নিয়ে কাজকারবার করে ক্র্যামস্ট্যাক। তাদের মূল কাজ ডেটা অ্যানালাইসিস বা তথ্য বিশ্লেষণ।

নাজমুস সাকিব ২০১৫ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএসইতে স্নাতক শেষ করে ইনসেপ্টাতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার (এমটিও) পদে চাকরি শুরু করেন। ওই সময়ে দেশের জনপ্রিয় টেক ভেঞ্চার হাইফাই পাবলিকের আয়োজনে একটি ইলেকশন হ্যাকাথনে অংশগ্রহণ করে ক্র্যামস্ট্যাক টিম। সেখান থেকে নিজেদের ধারণা পরিমার্জন করে ক্র্যামস্ট্যাকের পথচলা শুরু করে হাইফাই পাবলিকের ইনকিউবিউটরে। সেখানে তাঁদের ধারণাটি পুরস্কার পাওয়ার পর গ্রামীণফোনের অ্যাকসিলারেটর প্রোগ্রামে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের জিপি অ্যাকসিলারেটর ২য় ব্যাচের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। ‘অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট ও সিড ফান্ডিং’ পেয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ২০১৭ সালে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে ক্র্যামস্ট্যাক।

নাজমুস সাকিব নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, মেশিন লার্নিং নিয়ে নিজের উদ্যোগ চালু করার পরও পরিবার মেনে নেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকায় চাকরি ছাড়তে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই পরিবারকে না জানিয়ে গোপনে চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসার পেছনে সময় দিতে শুরু করেন। তবে জিপি অ্যাকসিলারেটরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর চাকরি ছাড়ার কথা আর গোপন থাকেনি। তখন থেকে পরিবারের সমর্থন নিয়েই পুরোদমে নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুরুতে প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নাম খুঁজছিলেন। কিন্তু এমন অপরিচিত নাম খুঁজছিলেন, যা সহজেই সবার মনে জায়গা করে নেবে। তখনই ক্র্যামস্ট্যাক নামটি মনে গেঁথে যায়। শুরু হয় এর পথচলা। এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠানে প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা (সিওও) হিসেবে যোগ দেন হাসিব মাহমুদ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোনেসুল হক, স্ট্র্যাটেজি ও ফাইন্যান্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট সালমান রহমান, জ্যেষ্ঠ ডেটাবিজ্ঞানী জাওয়াদুর রহমান।

ডিজিটাল যুগে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কমবেশি নানা রকম ডেটা বা তথ্য নিয়ে কাজ করছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবসায় কাজে লাগানোর পাশাপাশি নানা রকম কর্মপরিকল্পনার সুযোগও রয়েছে। ডেটাকে ডিজিটাল যুগের জ্বালানি বলা হয়। আর এই ডেটা নিয়েই কাজ–কারবার করছে ক্র্যামস্ট্যাক। বাংলাদেশের তরুণদের একটি স্টার্টআপ ক্র্যামস্ট্যাক। যদিও খটমটে এ নামের কোনো অর্থ নেই, তবে এর কার্যক্রম কিন্তু দারুণ অর্থবোধক। সাধারণ দৃষ্টিতে যেসব তথ্যকে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে ক্র্যামস্ট্যাক টিম তা বিশ্লেষণ করে অর্থবোধক ও কার্যকর করে তুলতে পারে। তাঁদের দাবি, দেশের একমাত্র ডেটা অ্যানালিটিকস বা তথ্য বিশ্লেষণী উদ্যোগ হিসেবে সফলভাবে কাজ করছে ক্র্যামস্ট্যাক।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডেটা অ্যানালিটিকসের চাহিদা বাড়ছে। দেশের মধ্যেও দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা রয়েছে। তবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণের কাজে প্রয়োজন বড় ডেটাবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানের। দেশে এ ধরনের সফল উদ্যোগের উদাহরণ হচ্ছে ক্র্যামস্ট্যাক। রাজধানীর বনানীতে ক্র্যামস্ট্যাকের প্রধান কার্যালয়। বর্তমানে ২২ জনের মতো কর্মী নিয়ে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ডেটা সায়েন্সের বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে কাজ করছে ক্র্যামস্ট্যাক। প্রতিটি দলে ৮ জন করে প্রকৌশলী রয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডসের ‘বিগ ডেটা অ্যানালিটিকস’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক্র্যামস্ট্যাক।

নাজমুস সাকিব জানান, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। সেখানে স্কোরকার্ড নামের একটি সিস্টেম তৈরি করেন, যা বিভিন্ন কেপিআই নিয়ে কাজ করতে পারে। ক্যাপাসিটি, নেট জেনারেশন, রিলায়েবিলিটি ও ফাইন্যান্সিয়াল কেপিআইয়ের মাধ্যমে এ খাতে লোকসান, আয়ের নানা তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিচালন খরচ, নতুন সক্ষমতা বের করাসহ দৈনন্দিন কার্যক্রমের নিখুঁত তথ্য পাওয়া যায়। এতে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হয়।

প্রতিষ্ঠানটি এনএলকিউ বা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ কোয়েরি নামের বিশেষ সেবা প্রদান করেছে। এটি মূলত মেশিন লার্নিং (এমএল) পদ্ধতি। ডেটার মধ্যে সার্চ করে প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে আনতে পারে তাদের সিস্টেম, যা বিশ্লেষণের বিশেষ একধরনের সফটওয়্যার। এ ছাড়া তারা গ্রাহক চাহিদার ভিত্তিতে নানা কাস্টমাইজড সেবা প্রদানের কাজ করে। যেকোনো প্রতিষ্ঠান তাদের চাহিদার কথা জানালে তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে ক্র্যামস্ট্যাক। তারা মূলত ‘বিজনেস টু বিজনেস’ বা বিটুবি মডেলে কাজ করে। ইতিমধ্যে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্র্যামস্ট্যাক। এ ছাড়া বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের রকস্টার্ট এআই নামের একটি প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে ক্র্যামস্ট্যাক—যেখান থেকে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করছেন।

ক্র্যামস্ট্যাক মূলত সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করতে আগ্রহী। ব্যাংকের জন্য ডেটা ক্লাস্টারিং, লাইফ সাইকেল অ্যানালাইসিস, ক্রেডিট স্কোরিং, ডেটা অ্যানালাইসিস প্রসেসের মতো নানা সেবা চালু করেছেন তাঁরা। তাদের সেবার মাধ্যমে ব্যাংকের অনেক তথ্য বিশ্লেষণ করা সহজ হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোকে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই নীতি বাস্তবায়ন করা হলে বছরে ৩০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। ক্র্যামস্টাক এই নীতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন এর উদ্যোক্তারা।