তিন সমস্যার সমাধান হলে সিমেন্টশিল্পের উন্নতি হবে

বিসিএমএর সভাপতি মো. আলমগীর কবির
বিসিএমএর সভাপতি মো. আলমগীর কবির
দেশের সিমেন্ট খাতের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) সভাপতি এবং এমআই সিমেন্টের (ক্রাউন সিমেন্ট) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ

বাণিজ্য: বাংলাদেশের সিমেন্ট খাতে এখন দেশীয় কোম্পানিগুলোই ভালো করছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? দেশীয় উদ্যোক্তাদের শক্তি আসলে কোন জায়গায়?

আলমগীর কবির: গত শতাব্দীতে বিদেশি কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করেছে। তবে ২০০০ সালের প্রথম দিকে কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান নজর কাড়তে থাকে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা ও বাজার হিস্যা বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে বিদেশি কোম্পানির বাজার হিস্যা ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ, তা বর্তমানে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতির পেছনে উদ্যোক্তাদের মনোবল, বিচক্ষণতা এবং দ্রুত সঠিক সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি কাজ করেছে। উদ্যোক্তারা অনুধাবন করেছিলেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিমেন্টের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। সে জন্যই তাঁরা তাঁদের কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত সম্প্রসারণ করেন। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে পেছনে পড়ে থাকে। এরই মধ্যে ভোক্তাদের মধ্যেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা বেড়েছে। বিপণন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনায়ও দেশীয় কোম্পানিগুলো অনেক সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে।

বাণিজ্য: বাংলাদেশের সিমেন্ট খাত আগামী দিনগুলোতে কতটুকু এগোবে? প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে কোন কোন বিষয়ের ওপর?

আলমগীর কবির: দেশের আবাসন খাত ও অবকাঠামো তৈরিতে সিমেন্টের ব্যবহার বেশি হয়। ভবিষ্যতে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বড় প্রকল্পগুলোতে সিমেন্টের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এককথায় বলা যায়, যত দিন উন্নয়ন থাকবে, তত দিন সিমেন্ট থাকবে। তবে জায়গার স্বল্পতা ও উচ্চ দাম, গৃহঋণের উচ্চ সুদহার ও অতিরিক্ত নিবন্ধন খরচের কারণে আবাসন খাত এগোতে পারছে না। এই তিনটি সমস্যার সমাধান করা গেলে আবাসন খাতের পাশাপাশি সিমেন্টশিল্পের উন্নতি হবে। বিভিন্ন জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উৎপাদিত সিমেন্টের ৫০ শতাংশই ঘরবাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে এ খাতটি সিমেন্টশিল্পের উন্নতিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারছে না।

বাণিজ্য: সিমেন্ট কারখানাগুলো এখনো কি সনাতন পদ্ধতিতে সিমেন্ট উৎপাদন করছে, নাকি বিভিন্ন ধরনের উন্নতি ও বিশেষায়িত সিমেন্ট উৎপাদন করতে পারছে?

আলমগীর কবির: সিমেন্ট কারখানাগুলো গত কয়েক বছরে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। বিশেষ করে দেশীয় বড় কোম্পানিগুলো বল মিলের পরিবর্তে আধুনিক ভিআরএমের (ভার্টিকেল রোলার মিল) মাধ্যমে উৎপাদন শুরু করেছে। প্রথমে আমাদের দেশে একমাত্র অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট হলেও বর্তমানে পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালেও বৈচিত্র্য নিয়ে আসছে কোম্পানিগুলো। বর্তমানে দেশেই অ্যাপ্লিকেশন বেজ (প্রয়োগভিত্তিক) বিশেষায়িত সিমেন্ট উৎপাদন করা সম্ভব। তা ছাড়া মান নিয়ন্ত্রণে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।

বাণিজ্য: সিমেন্ট খাতে কি নতুন বিনিয়োগ আসছে?

আলমগীর কবির: বর্তমানে সিমেন্ট খাতে নতুন বিনিয়োগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। তবে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতাই সিমেন্টশিল্পকে ক্রমে অলাভজনক খাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্য: আপনি চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কথা বললেন। তাহলে আগামী দিনগুলোতে বিনিয়োগকারীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে?

আলমগীর কবির: চাহিদার তুলনায় সিমেন্টের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। সিমেন্ট খাতে বর্তমানে ৩৮টি কোম্পানি আছে, যাদের কর্যকারী উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৬ কোটি ২ লাখ টন। এর বিপরীতে বর্তমানে চাহিদা আছে প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ টনের। ফলে সিমেন্ট প্রস্তুতকারীরা প্রায়ই তীব্র অসম প্রতিযোগিতায় নামছেন। এ ধরনের অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতা নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। বর্তমান আমাদের দেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ১৮২ কেজি, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম। দেশে চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সিমেন্টের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। তখন অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে সে অবস্থায় পৌঁছাতে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

বাণিজ্য: ছোট কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। সমিতির সভাপতি হিসেবে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আলমগীর কবির: যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে একটি ন্যূনতম পরিমাণের উৎপাদন ক্ষমতা ও বিতরণের সক্ষমতা থাকা উচিত। সেই হিসেবে ছোট কারখানাগুলোর পক্ষে তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা অনেক কষ্টসাধ্য। বড় উৎপাদকেরা স্থায়ী ব্যয় বা ফিক্সড কস্টকে উৎপাদিত অনেক পণ্যের ওপর ভাগ করে দিতে পারে। তাতে তাদের প্রতি একক পণ্যের খরচ কম হয়, যা ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীর পক্ষে সম্ভব হয় না। আমার মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে ছোট কারখানাগুলোর একত্রীকরণের দিকে নজর দেওয়া উচিত।

বাণিজ্য: সিমেন্ট উৎপাদন পরিবেশগত ঝুঁকির প্রশ্ন আছে। সেটা দূর করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

আলমগীর কবির: সিমেন্ট উৎপাদনে পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে পরিবেশগত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিসিএমএর যৌথ প্রয়াস চালানোর ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। কারখানাভেদে পরিবেশদূষণের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয়। ফলে সমিতির তরফ থেকে সদস্যদের পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

বাণিজ্য: সিমেন্ট রপ্তানির সম্ভাবনা কতটুকু? সম্ভাবনা ধরতে কী কী করার আছে?

আলমগীর কবির: প্রায় দেড় দশক আগে সিমেন্ট রপ্তানির দ্বার খুলেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে সিমেন্ট রপ্তানি খুব একটা বাড়েনি। উত্তর–পূর্ব ভারত ব্যতীত আর কোথাও রপ্তানির তেমন বিশেষ সুযোগ নেই। উত্তর–পূর্ব ভারতের সীমান্ত অবকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও উন্নতি হলে রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হবে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ, নেপাল ও ভুটানের অবকাঠামো উন্নতি হলে সিমেন্ট রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। তা ছাড়া সরকার যদি সিমেন্ট রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দেয়, তাহলে রপ্তানিতে কিছুটা গতি আসার সম্ভাবনা আছে।

বাণিজ্য: বর্তমান সিমেন্ট ব্যবসার প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?

আলমগীর কবির: চাহিদার তুলনায় উৎপাদনক্ষমতা বেশি হওয়ায় সিমেন্ট খাতের বর্তমান অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। তার মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত শুল্ক ও করকাঠামো, সিমেন্টশিল্পকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে। বাজেটে সিমেন্টের কাঁচামালের আমদানিতে ৫ শতাংশ এবং সরবরাহ পর্যায়ে ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা হয়েছে। এ দুটি পর্যায়ের অগ্রিম আয়করই অফেরতযোগ্য। এই অসহনীয় করকাঠামো সিমেন্টশিল্পের প্রসারের জন্য অন্তরায়। অন্যদিকে সিমেন্টশিল্প পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়লেও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সম্ভব হয় না। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজটের কারণেও কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে সিমেন্টশিল্পকে সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তার মধ্যে অন্যতম হলো করকাঠামো আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, গৃহঋণের সুদের হার কমানো, জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে রেজিস্ট্রেশন খরচ কমানো এবং সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ সহায়তা প্রদান করা।