অর্থমন্ত্রী, খেলাপি ঋণ কিন্তু বাড়ছেই

আ হ ম মুস্তফা কামাল । ফাইল ছবি
আ হ ম মুস্তফা কামাল । ফাইল ছবি

নতুন দায়িত্ব নিয়েই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ১০ জানুয়ারি ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠক শেষে বিশেষ এক ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘আজকের পর থেকে এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।’

সেটাই ছিল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর খেলাপি ঋণ বিষয়ে তাঁর প্রথম বক্তব্য। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে তিনি বারবার কথা বলেছেন। বাস্তবে যা-ই ঘটুক না কেন, প্রথম বক্তব্য থেকে তিনি কিন্তু একবারও সরে আসেননি। এই যেমন, এর পরের মাসে, ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ৭১ বিধিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বললেন, ‘সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করতে চাই, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না।’

এখানেই কিন্তু শেষ নয়। বাজেট পাসের পরে গত ২২ জুলাই অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের আবারও বলেন, ‘দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। আপনারা লিখেছেন, বেড়েছে। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণ বাড়েনি; বরং খেলাপি ঋণ কমেছে।’

অর্থমন্ত্রী এখানেই থেমে থাকেননি। গত ২৫ আগস্ট শেরেবাংলা নগরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বললেন, ‘খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়েনি। যদি কেউ দাবি করেন যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, তাহলে আমি এটা মানব না।’

এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী বৈঠকে বসেছিলেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবারও বললেন, ‘ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ বাড়বে না। কারণ, নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।’ কেন নেই—ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে যদি বিদ্যমান আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে খেলাপি ঋণ বাড়বে না। আর যদি বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া যায়, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রয়োজনে নতুন করে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আর এ কারণে বলছি, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আর হবে না।’

সবশেষে ১৩ নভেম্বর। জাতীয় সংসদে ওই দিন তিনি বললেন, ‘দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি।’

এবার দেখা যাক, ১১ মাস ধরে অর্থমন্ত্রীর বলা কথাগুলোর বিপরীতে বাস্তব চিত্রটা কী। অর্থমন্ত্রীর প্রথম সাফল্য হচ্ছে গত জানুয়ারি-মার্চ সময়েই দেশের খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া। ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। আর পরের তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বেড়েছে আরও ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে গত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রী অবশ্য ১৩ নভেম্বর সংসদে তাঁর বক্তব্যের পক্ষে একটি যুক্তি দেন। তিনি বলেছেন, ‘১৯৯১ সালে মোট ব্যাংকঋণ ছিল ১৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা; শতাংশ হারে ২৬ দশমিক ১৪। বর্তমানে ৯ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা ঋণ আছে। এর মধ্যে খেলাপি ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা; শতাংশ হারে ১১ দশমিক ৯৬। এই হিসাবে বলব, আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি।’

এ ক্ষেত্রে এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বক্তব্যটি মনে করা যেতে পারে। সংস্থাটি দুই মাস আগে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একটি রিপোর্ট দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে। এখানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ অবস্থা। আসলে ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশে সব সময়েই সমাদৃত। সব সময়েই নানা ধরনের সুবিধা পেয়ে আসছেন বলে গ্রহীতাদের বড় অংশই ঋণ পরিশোধের তাগিদ অনুভব করে না। কারণ, তারা জানে, আবারও সুবিধা দেওয়া হবে। ঋণখেলাপিদের মধ্যে এই ধারণা সম্ভবত আরও দৃঢ় হয়েছে গত জানুয়ারির পর। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন ছয় মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলে তবেই তা খেলাপি হবে, যা আগে ছিল তিন মাস। পাশাপাশি এককালীন ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ১২ বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করার সুযোগও দিয়েছে সরকার। এর সবই হচ্ছে ভালো গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করা ও খেলাপি গ্রাহকদের উৎসাহ দেওয়ার নীতি। সুতরাং ঋণ পরিশোধের তাগিদটা আসবে কীভাবে।

আইএমএফ তাদের রিপোর্টে যেমনটা বলেছে, ‘বাংলাদেশে প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী—এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক।’

এবার দেখা যাক, বিশেষজ্ঞরা কী বলেন। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত নিয়ে কাজ করছেন। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—অর্থনীতিতে এখন সুসময় চলছে। তাহলে তো ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলার কথা। এই ভালো সময়ে ব্যবসায়ীরা কেন খেলাপি হচ্ছেন? কেউ কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন, আর বেশির ভাগই স্বভাবের কারণে খেলাপি হচ্ছেন। এই স্বভাব বদলানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে কোনো আইনি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। তাঁর মতে, ২ শতাংশ এককালীন কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে ফল উল্টো হয়েছে। যারা স্বভাবের কারণে খেলাপি হচ্ছেন, তাঁরা মনে করছেন—পথ তো আছে। নিয়মিতভাবে এ ধরনের সুযোগ পাওয়া যাবে। যদি তাদের নতুন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত থাকত, তাহলে কিছুটা কাজ হতো। কিন্তু এ ধরনের খেলাপিদের অনেকেই নতুন ঋণও পেয়েছেন। এই ঋণখেলাপিদের আচরণগত পরিবর্তনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে কোনো অগ্রগতি হবে না। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের সংস্কার লাগবে।

এমনিতে অনেক দিন ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, খেলাপি ঋণ বিপজ্জনক মাত্রায়। সুতরাং একদিকে কমানোর আশ্বাস, অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের ক্রমাগত সুবিধা দিয়ে যাওয়ার নীতি থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে না এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অর্থনীতির জন্য সেটি মোটেই মঙ্গলজনক হবে না।

১৯৭২ সালের ১৯ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ জনতা ব্যাংক শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল। সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা। তাহলে সর্বশেষ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা কোনটি? গত ২০১৮ সালের ৯ জুন সংবাদ সম্মেলন করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) তৎকালীন সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপিদের ব্যাংক ডাকাত বলে অভিহিত করে শাস্তি চেয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে বলা যায়, বাংলাদেশের সর্বশেষ ডাকাতির ঘটনা জানা গেল গত বুধবার। এ ক্ষেত্রে ডাকাতির পরিমাণ সরকারি হিসাবেই ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এখন দেখা যাক, এই টাকা অর্থমন্ত্রী ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না। তবে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার যে নীতি সরকার নিয়েছে, তাতে খেলাপি ঋণ কমবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না।

যেমন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ছয় মাস পর্যন্ত কিস্তি না দিলে খেলাপি নয়—এই ঘোষণাই ক্ষতির কারণ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খেলাপি ঘোষণা তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাস করার মানে হলো ওই সময়ে ব্যাংকগুলো ওই সময়ে চাপ দিতে পারবে না। চাপ না দিলে ঋণ আদায় হয় না—এটা সব ব্যাংকার বলেন। ছয় মাস পরে যখন কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন টাকা দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না কোনো ঋণ গ্রহণকারীর। এতে একসঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা চলতি বছরের প্রথম কিস্তিতে দেখা গেছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়া দূরের কথা, বিদ্যমান শর্তগুলোই এখন শিথিল করা হচ্ছে। সরকার যতই মুখে বলুক না কেন খেলাপি ঋণ কমবে, শর্ত শিথিলের ফলে খেলাপি আরও বাড়বে।

এখন দেখা যাক অর্থমন্ত্রী পরবর্তী পদক্ষেপ কী গ্রহণ করেন।