ব্যবসায়ীদের এক দিনেই ক্ষতি সোয়া ৮ কোটি টাকা

নৌযানশ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত ঘাটগুলোতে কোনো পণ্য খালাস হচ্ছে না। তাই নদীতে অলস পড়ে আছে পণ্যবাহী লাইটার জাহাজ। গতকাল সকালে কর্ণফুলীর আনুমাঝির ঘাটে।  ছবি: সৌরভ দাশ(15)
নৌযানশ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত ঘাটগুলোতে কোনো পণ্য খালাস হচ্ছে না। তাই নদীতে অলস পড়ে আছে পণ্যবাহী লাইটার জাহাজ। গতকাল সকালে কর্ণফুলীর আনুমাঝির ঘাটে। ছবি: সৌরভ দাশ(15)

নৌযানশ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে এক দিনেই সোয়া ৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি গুনতে হচ্ছে দেশি-বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী ও পণ্যের আমদানিকারকদের। জাহাজ পরিচালনাকারী দেশি-বিদেশি সংস্থা ও আমদানিকারকদের তথ্য অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।

ধর্মঘট আহ্বানের প্রায় ২৪ ঘণ্টার মাথায় গতকাল শনিবার রাত ১১টায় তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক আফসার হোসেন চৌধুরী রাত সাড়ে ১১টায় প্রথম আলোকে জানান, গতকালের বৈঠকে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কে এম মিজানুর রহমান আগামী মার্চের মধ্যে নৌশ্রমিকদের অন্যতম দাবি খাদ্য ভাতা মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এ ছাড়া আন্তমন্ত্রণালয়ের আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে অন্য দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এর আগে এ কর্মবিরতিতে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, মোংলা বন্দরে পণ্য বোঝাই ও খালাস এবং পরিবহনকাজ সীমিত হয়ে পড়ে। ঢাকা নদীবন্দর সদরঘাট টার্মিনাল, বরিশাল নদীবন্দরে যাত্রী নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়ে দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা। বিপাকে পড়ে রোগী, নারী-শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। মালিকপক্ষের চাপে কিছু লঞ্চ, ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল করলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সংগঠন সূত্রের ভাষ্য, দেশের প্রায় ২০ হাজার নৌযানের দুই লাখ শ্রমিক এ কর্মবিরতি পালন করেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নৌ ধর্মঘটে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও আমদানি পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল কারখানায় নেওয়া এবং বাজারজাত করতে যে সরবরাহব্যবস্থা রয়েছে, তা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। কর্মবিরতি প্রত্যাহার হলেও তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, এক দিনের ক্ষতি যদি কারও মাথায় থাকে, তাহলে এভাবে কেউ কর্মবিরতি করতে পারে না। সমুদ্রগামী জাহাজ অলস বসে থাকার জন্য যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, আমদানিকারকদের তা বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। এই আর্থিক ক্ষতি শেষ পর্যন্ত পণ্যের আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোক্তার কাঁধে পড়বে।

গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরুর পরই চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে নদীপথে ও ঘাটে পণ্য সরবরাহব্যবস্থা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল ও শিল্পমালিকদের পরিচালনাধীন ১ হাজার ২৮৬ লাইটারেজ জাহাজে আটকা পড়ে ১৮ লাখ টন পণ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা ৫৭টি সমুদ্রগামী জাহাজে আটকা পড়ে সাড়ে ১৩ লাখ টন পণ্য। সব মিলিয়ে সাগরে বড় জাহাজে ও নদীপথে ছোট জাহাজে সাড়ে ৩১ লাখ টন পণ্য আটকা পড়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা বড় জাহাজ সাগরে রেখে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করা হয়। এরপর এসব লাইটারেজ জাহাজ ধারাবাহিকভাবে দেশের নানা ঘাটে নিয়ে পণ্য খালাস করা হয়। এই পণ্যের মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, সিরামিকস ও ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল, সার, কয়লা ও ভোগ্যপণ্য। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারবিহীন জাহাজে ৬ কোটি ৪০ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়, যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি টন বা ৭৮ শতাংশ খালাস হয় বহির্নোঙরে। এ হিসাবে দিনে বহির্নোঙরে গড়ে ১ লাখ ৩৬ হাজার টন পণ্য বন্দর থেকে খালাস হয়ে নদীপথে পরিবহন হয়।

কার কত ক্ষতি

বন্দর দিয়ে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা বড় জাহাজগুলো থেকে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানিকারকেরা প্রতিদিন গড়ে নির্ধারিত পরিমাণ পণ্য খালাস করার শর্তে জাহাজ ভাড়া নেন। সময় বেশি লাগলে জরিমানা গুনতে হয় তাঁদের। সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী দেশীয় কোম্পানি কবির গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আজকের হিসাবে বন্দরে আসা বড় জাহাজগুলোর প্রতিদিনের ভাড়া পড়ে ১২ হাজার ডলার। জাহাজ যদি অলস বসে থাকে, তা ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী জাহাজ পরিচালনাকারী বা আমদানিকারকদের গুনতে হয়।

বন্দরের হিসাবে, এখন বহির্নোঙরে সমুদ্রগামী বড় জাহাজ অলস বসে আছে ৫৭টি। এতে দিনে গড়ে ১২ হাজার ডলার করে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ডলার ক্ষতি হচ্ছে। টাকার অঙ্কে তা পৌনে ৬ কোটি টাকার বেশি।

বড় জাহাজ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ নদীপথে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালন ব্যয় রয়েছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি লাইটারেজ জাহাজের গড়ে দিনে পরিচালন ব্যয় ২০ হাজার টাকা।

এ হিসাবে ১ হাজার ২৮৬ লাইটারেজ জাহাজের দিনে পরিচালন ব্যয় বাবদ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজ ও ছোট জাহাজের এক দিনের ক্ষতি ৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

ব্যবহারকারীদের বক্তব্য

বহির্নোঙরে সবচেয়ে বেশি খালাস হয় সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার। এ বিষয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি কারখানার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করে কারখানায় নেওয়া হয়। এখন সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ হওয়ায় শুধু জাহাজ ভাড়া বাবদ ক্ষতিপূরণই গুনতে হচ্ছে না, পুরো সরবরাহব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।

সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন একেকটি বড় সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বাবদ তাঁদের ১৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। এই ক্ষতিপূরণ পণ্যের খরচের সঙ্গে যুক্ত হবে।

নৌযানশ্রমিকদের ১১ দফা দাবির মধ্যে ছিল নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ, ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের কেরানি, কেবিন বয়, ইলেকট্রিশিয়ানসহ নৌশ্রমিকদের বেতন প্রদান, খাদ্য ভাতা প্রদান।